সূর্যস্পর্শী পার্কার সোলার প্রব



লিখেছেন
সৌরভ সিংহ

আমাদের এ অন্ধকার সৌরমন্ডলের একচ্ছত্র অধিপতি ও এক মাত্র নক্ষত্র সূর্য। সূর্যের নির্যাসে আমদের আজকের সৌরমন্ডলের এত মধুর ঐকতান। আজকের আমদের পৃথিবীর প্রতি ধুলিকনায়,জীবত কোষে রয়েছে তার নির্জন স্বাক্ষর। সেই তেজ্স্বী নক্ষত্র এবং এর অভ্যন্তরে অবিরাম ফিউশন বিক্রিয়া চলার দরুন সৃষ্ট প্রচন্ড তাপ ও আলোর উৎস সম্পর্কে জানার আগ্রহ মানুষের অনেক দিন থেকে। কিন্তু এত বিরাট জ্বলন্ত চুল্লীর কাছাকাছি পৌছানো বড় কথা নয়। এতদিন সূর্য সম্পর্কে ধারনা তাই আমাদের পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকেই বিভিন্ন পর্যবেক্ষন লব্ধ ও তত্ত্বীয় জ্ঞানের উপর সীমাবদ্ধ ছিল। এবার মানুষের ক্ষমতা হয়েছে সে প্রচন্ড তপ্ত চুল্লীতে হাত দেয়ার। এবারই প্রথম সূর্যের বায়ুমন্ডলে গিয়ে তথ্য পাঠাবে বিজ্ঞানী ইউজিন পার্কারের নামে নামকরন করা হয় “পার্কার সোলার প্রব”। গত ১২ই আগস্ট ২০১৮ তারিখে ডেল্টা - ৪ মহাকাশযানে করে পাড়ি দেয় এই সোলার প্রবটি।

পার্কারের ইতিহাস:

১৯৫৮ সাল। ইউজিন পার্কার এর সৌর ঝড়(Solar Flare) নিয়ে সাড়া জাগানো গবেষনাপত্রটি ‘অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল’ নামের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল এ ছাপাতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। রিভিউ করারনোর জন্য দু দুবার পাঠানো হলো কিন্তু দুবারই বাতিল করা হল তার গবেষনাপত্রটি। অবশেষে আরেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর ছিলেনঐই জার্নালের এডিটর। দুজন রিভউয়ারের মতামত উপেক্ষা করেই তিনি গবেষনাপত্রটি ছাপানোর সুপারিশ করলেন। ইউজিন পার্কারের সৌর ঝড়ের বিষয়টি প্রবল সাড়া পড়ে সে সময়। সৌর ঝড় কি?  সৌর ঝড় হচ্ছে সূর্যের অভ্যন্তরে বিস্ফোরনের কারণে এর উপরিভাগ থেকে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো বিস্ফোরণের মাধ্যমে এর ভেতরের গলিত উত্তপ্ত পদার্থগুলো নিঃসরিত হয়। সৌরজগতের এ ঘটনাটি ঠিক তখনি ঘটে যখন সূর্যের বাঁকানো চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো একটি আরেকটিকে অতিক্রম করে ও পুনরায় যুক্ত হয়। এর ফলে যে বিস্ফোরণ ঘটে তার শক্তিমত্তা প্রায় কয়েক লক্ষ হাইড্রোজেন বোমার সমান। এ বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট এক্স-রে ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বের সর্বত্র।এই কনাগুলোর গতিবেগ ঘন্টায় ১৮
লক্ষ মাইল এর মত। সৌর ঝড়ের কারনে প্রচুর পরিমান চার্জিত কনা নিঃসৃত হওয়ায় বিঘ্নিত হয় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। এছাড়াও স্যাটেলাইট এর উপর প্রভাব পরে বেশি, যার ফলে স্যাটেলাইট বিকল হয়ে গিয়ে মোবাইল নেটোয়ার্ক থেকে শুরু করে আবহাওয়া্র পূর্বাভাস প্রদান করা ও আকাশে ভাসমান উড়োজাহাজ এর ভূমির সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।  এই সৌর ঝড়ের প্রভাব পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের উপর পরে না, কারন পৃথিবীর বায়ুমন্ডল এই রশ্মিগুলো শুষে নেয় পৃথিবী নিরাপদ থাকে। পার্কারের এই সৌর ঝড়ের মূল উৎস এবং কারন এখনো স্পষ্ট নয়। সেটা জানতেই এখন পর্যন্ত কোন জীবিত বিজ্ঞানীর নামে কোন মহাকাশযান প্রেরন করা হল।

সূর্যে যাওয়া এত কঠিন কেন? 

সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিন করে তার থেকে তথ্য বয়ে নিয়ে আসতে প্রথমে মহাকাশযানকে সূর্যের কাছাকাছি জায়গায় নিয়ে যেতে হবে কিন্তু এতে বড় বাধা ছিল পৃথিবী আর শুক্র গ্রহের জোড়ালো অভিকর্ষ বল। এই অভিকর্ষ বলের টান এড়িয়ে সূর্যের কাছকাছি পৌছানো মোটেও সহজ কথা ছিল না। এর জ্ন্য চাই প্রচন্ড গতি। মঙ্গলে পৌছানোর জন্য একটি মহাকাশযানকে এই অভিকর্ষ বলে কাটিয়ে উঠতে যে শক্তি দরকার হয় তার ৫৫ গুন  বেশি শক্তি নিয়ে ছুটতে হবে সূর্যের কাছাকাছি পৌছানোর জন্য। এর গতিবেগ হবে  ঘন্টায় প্রায় ৪৩০০০ মাইল যেখানে মঙ্গলে পৌছাতে ঘন্টায় ২৯০০০ মাইল এবং অনেক দূরের প্লুটোতে পৌছাতে ঘন্টায় ৩৬০০০ মাইল। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে গতিসম্পন্ন মহাকাশযান এটি। এই প্রচন্ড গতির মহাকাশযান তৈরি করতে যে প্রযুক্তির প্রয়োজন তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের।
আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপ। করোনা বা সূর্যের বাহিরের  অংশের তাপমাত্রা গড়ে প্রায় ১০ লক্ষ্য ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি। এত প্রচন্ড উত্তাপে তথ্য সরবরাহকারী যন্ত্রাংশগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য যে আবরন বা শিল্ড দরকার ছিল তা বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল না। “হিট শিল্ড” এর মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা হয়েছে ।

পার্কারের গুরত্বপূর্ন অংশ ও গতিপথঃ

পার্কার সোলার প্রব পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে করতে শুক্র গ্রহে (ভেনাস) পৌঁছবে আজ থেকে  প্রায় দেড় মাস পর, অক্টোবরে। এরপর অনেক পথ পাড়ি দিয়ে  মহাকাশযানকে সূর্যের বায়ুমন্ডলে পৌঁছতে সময় লাগবে কম করে হলেও ২ থেকে ৪ বছর। অর্থ্যাৎ ২০২০ সালের অগস্টের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম সৌর বায়ুমন্ডলে পৌছাবে পার্কার মহাকাশযান। তারপর তা আরও এগিয়ে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরের স্তর বা করোনায় ঢুকে পড়বে ২০২২ সালের মাঝামাঝি। টানা ৭ বছর ধরে বিভিন্ন কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে নাসার এই মহাকাশযান। সেই প্রদক্ষিণের সময় কখনও তা কাছে আসবে সূর্যের, কখনও কিছুটা দূরে চলে যাবে। এই মহাকাশযানটি যখন সবচেয়ে কাছে চলে যাবে সূর্যের, তখন সূর্যের পৃষ্ঠ (সারফেস) থেকে তার দূরত্ব হবে মাত্র ৩৮ লক্ষ ৩০ হাজার মাইল।
করোনা হচ্ছে সূর্যের দৃশ্যমান অঞ্চল। প্রধানত সূর্যগ্রহন এর সময় যে আলোকিত অঞ্চলটি দেখা যায় সেটাই করোনা।এই করোনা অঞ্চলের তাপমাত্রা আগেই বলেছিলাম যে গড়ে প্রায় ১০ লক্ষ্য ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মত। এত তাপ থেকে রক্ষার জন্য সোলার প্রবের যে অংশ সূর্যের দিকে থাকবে, সে অংশে কম্পোজিট কার্বনের তৈরি খুব হালকা  হিট শিল্ড স্থাপন করা হয়েছে যা প্রায় ৩ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ১ হাজার ৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও গলে যাবে না। তাহলে করনার এত উচ্চ তাপমাত্রা অঞ্চলে পার্কার টিকে থাকবে কিভাবে?  এক্ষেত্রে তাপ ও তাপমাত্রার পার্থক্য বোঝাটা গুরত্বপূর্ন। কোনও কণা বা কণিকা কত বেগে  ছুটছে, তার ওপর নির্ভর করে তার তাপমাত্রার বাড়া, কমা। তাপমাত্রা আসলে ওই গতিশীল কণা বা কণিকাদের গতিবেগের পরিমাপক। আর তার ফলে মোট যে পরিমাণ শক্তির আদানপ্রদান ঘটে এক জায়গা থেকে অন্যত্র, তার মান ধরা পড়ে তাপে। কণা বা কণিকারা খুব জোরে ছুটলে তাপমাত্রা বেশি হবে। কিন্তু সেই কণিকারা যদি সংখ্যায় অল্প হয়, তা হলে তাদের ছোটাছুটির ফলে মোট শক্তির পরিমাণও কমে যাবে। ফলে, তাপ কম হবে সে ক্ষেত্রে। মহাকাশে কণা বা কণিকার সংখ্যা যেহেতু অল্পই, তাই এসব কনার ধাক্কায় মহাকাশযানের পৃষ্ঠে বেশি তাপ বাড়াতে পারে না। পার্কার সোলার প্রোব সূর্যের বায়ুমণ্ডলের যে স্তরে ঢুকবে, তার তাপমাত্রা ১০ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি। তবে করোনার সব জায়গার তাপমাত্রা একই রকমের নয়। তা কোথাও কম, কোথাও বেশি। যেমন একটি গরম ওভেন আর ফুটন্ত জলের মধ্যে হাত ডোবালে আমাদের কী অনুভূতি হয়? ওভেনে অনেক বেশি তাপমাত্রাতেও অনেক বেশি সময় ধরে হাত রেখে দিতে আমাদের ততটা অসুবিধা হয় না। কিন্তু তুলনায় কম তাপমাত্রার ফুটন্ত জলে বেশি সময় আমরা হাত ডুবিয়ে রাখতে পারি না। কারণ, জলে কণার সংখ্যা বেশি। তাদের ছোটাছুটির ফলে বেশি পরিমাণে শক্তি এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাচ্ছে। একই ভাবে সূর্যের পিঠের চেয়ে করোনায় কণার সংখ্যা কম। ফলে, করনায় ঢোকা পার্কার মহাকাশযানকে গরম প্লাজমা কণাদের ঝাপটা তুলনামূলক কম সইতে হবে। ওই মহাকাশযানে যে ‘হিট শিল্ড’ রয়েছে,  তা খুব বেশি হলে ১ হাজার ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা আড়াই হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার সম্মুখীন হতে হবে। আর হিট শিল্ডটি সূর্যের দিকে থাকবে যাতে ভিতরের যন্ত্রাংশগুলোর তাপমাত্রা কক্ষতাপমাত্রায় থাকে। এছাড়াও রয়েছে অত্যাধুনিক কুলিং সিস্টেম যা প্রতিনিয়ত সোলার প্রবের যন্ত্রাংশ গুলো ঠান্ডা রাখবে।

যেসব তথ্য এনে দিবে পার্কার সোলার প্রব:

এই সোলার প্রব থেকে প্রাপ্ত তথ্য  সৌর ঝড় এর কারন ও এর পিছনের উৎসের অনুসন্ধান করতে বিরাট ভুমিকা রাখবে এবং এর নিয়ন্ত্রনের প্রক্রিয়া অনুসন্ধানে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। সুর্যের বায়ুমন্ধলের ভিতরে এর উপস্থিতির ফলে প্রথমবারের মত সৌর ঝড়ের অভ্যন্তরের কি কি  কনিকা আছে আছে এবং তার গতিবেগ কত তা নির্ভুলভাবে মাপা যাবে।
সাধারনত আমরা জানি যে  পৃষ্ঠের তাপমাত্রা কেন্দ্রের তাপমাত্রার চেয়ে কম হয়। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য যে সূর্যের করনা অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় ১০ লক্ষ্য ডিগ্রি সেলসিয়াস যেখানে তার পৃষ্ঠের  তাপমাত্রা বড়জোড় ৬ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই ঘটনার  কারন এখনো অজানা ছিল আমাদের । এর পার্কার সোলার প্রব এই সমস্যার সমাধান করবে। এছাড়াও সূর্যের অভ্যন্তরের ঘটনাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে জানার মাধ্যমে নক্ষত্রের সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যাবে। সেই সাথে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্বের অনেক তথ্য আমরা জানতে পারব। নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে সত্য উদঘাটনের।



Post a Comment

0 Comments