মৃত্যঞ্জয় মহাপ্রান


লিখেছেন
সৌরভ সিংহ



“অসীম শুন্যতার ,গাঢ় অন্ধকারে আছন্ন ছিল সব। এই শুন্যতার মাঝে নিক্স নামে বিরাটাকার কালো  ডানাওয়ালা পাখি  বাতাসে এক বিরাট ডিম স্থাপন করেন। দীর্ঘকাল পড়ের সেই ডিম এ প্রান সঞ্চার হয় এবং সৃষ্টি হয় ইরোস নামের  প্রেমের দেবতা । সেই ডিমের এক খোলস থেকে তৈরি হয় আকাশ এবং আরেক খোলস থেকে  মাটি । ইরোস এদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করেন এভাবে তৈরি হয় পৃথিবী ।” এটা গ্রীক পুরানের পৃথিবী সৃষ্টির বর্ননা। মানুষ আদিম কাল থেকেই তার এবং তার আশে পাশের জগতের বর্ননা  করতে চেয়েছে,প্রশ্ন করেছে  কি? কেন? কিভাবে? এসব হয়েছে। আমাদের সৃষ্টিই বা কিভাবে, কে বা তার স্রষ্টা । এসব প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে এসেছে নানা মানুষের নানা বিশ্বাসের নানান রকম সৃষ্টিতত্ত্ব । আর এই সৃষ্টির আদি বা সৃষ্টি কিভাবে হলো তার ধ্বজ্জা এক সময় বিজ্ঞান কাঁধে তুলে নিলো । বিজ্ঞান এর ইতিহাসে এক দল ডুবুরী নিরলস ভাবে  মহাবিশ্বের মহাসমুদ্রের অতলে গিয়ে   মুক্তা আহরন  করার চেষ্টা করেছেন। এক সময় সংঘর্ষ হলো মানুষের বিশ্বাস আর  বিশ্বাসকে পুজি করা শাসক গোষ্ঠীর এবং যুক্তি ও পর্যবেক্ষন লব্ধ জ্ঞানের সাথে। পুড়িয়ে মারা হলো হাইপেশিয়া কে,জীবন দিতে হলো ব্রুনো কেও,গ্যালিলিও চোখে আংগুল দিয়ে সূর্যের চারদিকে গ্রহসমূহের ঘূর্নণ দেখিয়ে দেয়ার অপরাধে কারাবাসে গেলেন। সেই ধারাবাহিকতায় নিউটন ,আইনস্টাইন  এর মত বড় বড় বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সৃষ্টি জানতে চেষ্টা করেন। আইনস্টাইন পরবর্তী কালীন হুইল চেয়ারে আবদ্ধ এক তরুন বললেন তার “ থিওরি অফ এভ্রিথিং”(Theory of Everything) বর্ননা দিবে মহাবিশ্বের ইতিহাস । তিনিই হচ্ছেন স্টিফেন উইলিয়াম হকিং, শুদ্ধ বিজ্ঞান  সাধক ও মানবতাবাদী, জীবন সংগ্রামী মানুষ।

শৈশব ও জন্মঃ
১৯৪২ সাল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দামামা চতুর্দিকে । একদিকে জাপান আমেরিকার পার্ল হার্বার আক্রমন করে আমেরিকাকে যুদ্ধক্ষত্রে দৃশ্যমান করেছে অপরদিকে সোভিয়েত এর রেড আর্মির আক্রমণে বিপর্যস্ত জার্মান বাহিনী । এমনি এক দৃশ্যপটে ৮ই জানুয়ারী গ্যালিলিওর মৃত্যুর ৩০০তম বছরে অক্সফোর্ডে জন্ম হয় স্টিফেন হকিং এর । হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসোবেল হকিং ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী। মেধাবী পরিবারেই হকিং এর জন্ম হয় যদিও তার পড়তে  শিখতে তার সময় লেগেছিল আট বছর। তিনি তখনকার শিক্ষা ব্যাবস্থাকেই দায়ী করে ছিলেন । স্কুলে হকিং খুব বেশি সুবিধা করতে পারেন নি যদিও তার অপরিচ্ছন কাজকর্ম আর হাতের লেখা ছিল শিক্ষকদের কাছে হতাশাজনক এমনকি স্কুলের ইউনিফর্মটিও নোংরা থাকত অনেক সময়। বারো বছর বয়সে তার এক বন্ধু তো বাজি ধরেই বসেছিল যে হকিং কে দিয়ে জীবনে কিছু হবে না। অনেক সময় তার মধ্যে প্রতিভার ঝলক দেখে আইনস্টাইন বলে ডাকত অনেকে।
স্টিফেনের প্রশ্ন করার ও খুটিনাটি জেনে নেয়ায়ার অগ্রহ ছিল খুব, একবার স্কুল থেকে তাদের ক্যাডেট ফোর্সের কমান্ডার কর্নেল প্রাইক এর নেতৃত্বে আই সি আই কোম্পানীর রাসায়নিক কারখানা দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। লাঞ্চের সময় কারখানার এক বিজ্ঞানী প্রাইককে ডেকে নিয়ে বলেন, “ আপনি এ কাদের নিয়ে এসেছেন? এরা এমন বিদঘুটে প্রশ্ন করে যে উত্তর দিতে জান বেড়িয়ে যায়”
১৯৫৯ সালে । ইউরোপ-আমেরিকাতে একটা জিনিস খুব বেশি চলে বাবা-মা চায়, তাদের সন্তান তাদেরই ইউনিভার্সিটিতে পড়ুক; তারা যে হাউজে থাকতেন, সেই হাউজেরই সদস্য হোক নিজ নিজ হাউজের জন্য অনেকে অনেক অনুদানও দেয়।তাই বাবা বললেন তোমাকে ডাক্তার হতে হবে হকিং গো ধরলেন গনিত নিয়ে পড়বেন। কিন্তু অক্সফোর্ডে তখন গনিত পড়ানো হত না । তাই তিনি পদার্থ বিজ্ঞানেই ভর্তি হন। যাই হোক, তরুণ হকিং  “আইনস্টাইন” ডাকনামটার নামকরণের সার্থকতা যাচাই করে যাচ্ছিলেন অক্সফোর্ডে এসেও। পড়াশোনা নাকি পানিভাত ছিলো তার কাছে। তাকে পদার্থবিজ্ঞানে একাডেমিক কোনো সমস্যা দিলেই সমাধান হাজির- এটা তার তৎকালীন প্রফেসর রবার্ট বারম্যানের মন্তব্য। এজন্য পড়াশোনার দিকে তার ধ্যান ছিলো খুবই কম। অনার্স জীবনের তৃতীয় বছরে পড়াশোনা বলতে প্রায় বাদ দিয়ে টোঁটো করে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, বন্ধু বান্ধব বানানোর দিকে মনযোগ দিলেন। চতুর্থ বছরে, ফাইন্যাল পরীক্ষার ফলাফল এমন হলো যে ফার্স্ট ক্লাস নাকি সেকেন্ড ক্লাস- সেটা নির্ধারণের জন্য ভাইভা প্রয়োজন হলো। অমনযোগী ছাত্র হিসেবে ততদিনে তিনি বেশ সুনাম কামিয়েছেন। ভাইভাতে গিয়ে তিনি সেটার সুযোগ নিলেন। ভবিষ্যত পরিকল্পনা জিজ্ঞেস করার পর তিনি যা বলেছিলেন, সেটা সরাসরি অনুবাদ করে তুলে দিচ্ছি, “যদি আমাকে ফার্স্ট ক্লাস দেন, তাহলে কেম্ব্রিজে চলে যাবো, ওখানে গিয়ে মহাবিশ্বতত্ত্ব পড়বো। যদি সেকেন্ড ক্লাস দেন, তাহলে অক্সফোর্ডেই থাকবো। মনে হয়, ফার্স্ট ক্লাস দিয়ে বিদেয় করে দিলেই ভালো হবে”তিনি ভাইভা বোর্ডের শ্রদ্ধা অর্জন করলেন, ফার্স্ট ক্লাস পেলেন, শুরু করলেন কেম্ব্রিজের পিএইচডি জীবন
মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
১৯৬২ এর অক্টোবরে কেমব্রিজ এ পা রাখলেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল ওই সময়ের বিখ্যাত বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হয়েল এর সাথে কাজ করার । কিন্তু তিনি দেখলেন তার গবেষনা তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হয়েছেন ডিনিস স্কিয়ামা তাতে তিনি বিরক্ত হলেন । কারন তিনি তার নামও শোনেন নি কোন কালে। তবে দেখা গিয়েছিল এটাই তার জন্য আশীর্বাদ হয়েছিল । সদা উৎসাহদানকারী স্কিয়ামা তাকে অনেক সহযোগীতা করতেন তার গবেষনায়। প্রাক নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এক পার্টিতে দেখা হয় জেন ওয়াইল্ড নামের এক তরুনীর সাথে যার সাথে স্টিফেনের পরবর্তীতে সখ্যতা ও সম্পর্ক গড়ে উঠে।
 পেশী নাড়ানো যায় না, আস্তে আস্তে শরীর দুর্বল হতে থাকে, শারীরিকভাবে অথর্ব হয়ে পড়ে রোগী, কথা বলা অসম্ভব হয়ে যায়, খাবার গেলা যায় না, আস্তে আস্তে নিঃশ্বাসও আটকে যেতে থাকে – কারণ এই রোগে পেশী নাড়ানোর জন্য যে নিউরনগুলো দায়ী, সেগুলোর মৃত্যু ঘটতে থাকে আস্তে আস্তে। রোগের নাম মোটর নিউরন রোগ বা Amyotrophic lateral sclerosis (ALS). এই রোগে আক্রান্ত রোগী মারা পড়ে কয়েক বছরের মধ্যেই। আর সেই রোগে স্টিফেন হকিং আক্রান্ত হলেন মাত্র ২১ বছর বয়সে, ১৯৬৩ সালে। ডাক্তাররা বললো, হাতে আর দু বছরের মত সময় আছে। কোনো কোনো ডাক্তার বললো, ২৫ বছর পর্যন্ত বাঁচবেন না হকিং।
এটা জানার পর মানসিকভাবেও ভেঙে পড়লেন তিনি, পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাইলেন। ডাক্তাররা বললো, “ব্যস্ত থাকো, কিছু একটা নিয়ে লেগে থাকো। পড়াশোনাটা ছেড়ো না”। তার সুপারভাইজার ডেনিস সিয়ামাও বললেন, “এসো, আমি জানি, তুমি পারবে”। সবচেয়ে বড় খুঁটি হয়ে পাশে দাঁড়ালো সদ্য প্রেমিকা জেইন ওয়াইল্ড। বললো, “চলো, আমরা বিয়ে করে ফেলি”।
হকিং সেই সময়ের কথা রোমন্থন করে বলেছিলেন, “আমাদের বাগদান (এঙ্গেইজমেন্ট) আমাকে বেঁচে থাকার রসদ যুগিয়েছিলো”। ১৯৬৫ সালে দুজন বিয়েও করে ফেললেন। অতঃপর ১৯৬৫ সালে বিয়েও করে ফেললেন দুজন। ১৯৮৫ সালে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হওয়ার পর তার ট্রাকিওস্টমি অপারেশন হয়। তারপরেই তিন কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ক্যালিফর্নিয়ার কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ওয়াল্ট ওলটোজ তার জন্য ইকুয়েলাইজার তৈরি করেন যার মাধ্যমে স্ক্রিনে ভেসে আসা অক্ষর থেকে চোখ বা মাথা নাড়িয়ে বাক্য তৈরি করা যায়।  এভাবেই তিনি পরবর্তীতে গবেষণা বা বক্তৃতা দিতেন।
মহাবিশ্বতত্ত্ব ও থিওরি অব এভ্রিথিং
ডাক্তার যখন বলছিলেন, শরীর আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যাবে, পেশী নাড়ানো যাবে না এবং অন্যান্য অংগ গুলোও বিকল হয়ে যাবে তখন হকিং জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তার ব্রেইন এর কি হবে?” সব কিছু ছাপিয়ে তার চিন্তা ছিল তার তার মস্তিষ্কের প্রতি যে মস্তিষ্ক দুনিয়া পরিবর্তন করেছে ,মানুষকে সভ্য করেছে। সেই একমাত্র অক্ষত অংগ মস্তিষ্ক নিয়ে ফিরে আসলেন কেম্ব্রিজে। উদ্দ্যেশ্য গবেষনা করবেন মহাবিশ্বতত্ত্ব নিয়ে , বুক চিরে বের করবেন মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য ও মহাবিশ্বের উৎপত্ত্বির সূত্র যার জন্য কোন সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন হবে না। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি গবেষনা করেছেন এই সম্প্রসারমান মহাবিশ্ব ও সিংগুলারিটি নিয়ে।
বিশপ উসার হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয় তিনি ওল্ড টেস্টামেন্ট এর বর্নিত  রাজাদের বয়স হিসেব করে দেখিয়েছিলেন। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল এর মত কিছু মানুষ মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কিত চিন্তা বা কৌতুহল ভালো দৃষ্টিতে দেখতেন না তারা মনে করতে এটা ঈশ্বরের উপর হস্তক্ষেপ । আর এর আগে পর্যন্ত মহাবিশ্বের ব্যাখ্যায় ধর্মতত্ত্বের উপর নির্ভর করত সবাই। মহাবিশ্ব সম্পর্কে উনবিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত মানুষের ধারনা ছিল মহাবিশ্ব স্থির। গ্রহ ,নক্ষত্র ও অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুগুলো চিরকাল যেমন ছিল তেমনি আছে। কিন্তু বিজ্ঞানী ভন লুডভিগ এর তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্র এর প্রমান হাজির করল, দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী ,মহাবিশ্বের বিশৃংখলার মোট পরিমান কালের বৃদ্ধির সাথে সাথেই বর্ধমান। তাহলে স্থির মহাবিশ্বের ধারনা অনুযায়ী মহাবিশ্ব এত দিনে চরম বিশৃংখল অবস্থায় চলে যেত এবং তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পরিমান বৃদ্ধি পেত। এ থেকে ধারনা জন্মাতে শুরু করে প্রসারমান মহাবিশ্বের । কিন্তু স্থির মান মহাবিশ্বের চিন্তা এতই প্রকট যে স্বয়ং আইনস্টাইন মহাবিশ্বের  প্রসারমানতা ধরতে পারলেন না যদিও তার আপেক্ষিকতার সাধারন তত্ত্ব বলে যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারমান। পরবর্তীতে এডুইন হাবল ১৯২৯ সালে ‘হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারমান। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা সম্প্রসারমান মহাবিশ্ব নিয়েই গবেষনা করেন। তাহলে যদি একটু পিছনে ফেরা যায় এই সম্প্রসারনের পূর্বে তাহলে নীহারিকা ও অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুগুলো একসাথে ছিল। এমনকি নীহারিকাগুলো পরষ্পরের সাথে চাপানো ছিল এবং মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিল অসীম ? নাকি তারা পরষ্পর পাশ কাটিয়ে আবার পরস্পরের থেকে দূরে অপসারন করেছিল?  কিন্তু এসব প্রশ্নের  ব্যাখ্যা করার মত পরিপূর্ন গনিতিক কাঠামো তৈরি হয় নি। স্টিফেন হকিং এবং স্যার রজার পেনরোজ প্রথম একটি গানিতিক কাঠামো দাড় করানোর চেষ্টা করেন। অপরদিকে ব্যাপক আপেক্ষবাদ যদি ঠিক হয় তাহলে অতীতে নিশ্চই একটা অসীম ঘনত্বের অবস্থা ছিল। এই অসীম ঘনত্বের এর অবস্থাকে বলা হয় সিংগুলারিটি বা বৃহৎ বিস্ফোরন এর অনন্যতা। হকিং এবং পেনরোজ এর গবেষনা ছিল এই কোয়ান্টাম মেক্সানিক্স দিয়ে এই সিংগুলারিটির ব্যাখ্যা যা  মহাবিশ্বের আরম্ভ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করবে। এই ব্যাপক আপেক্ষবাদ ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যাবহার করে সিংগুলারিটির এই ব্যাখাই হকিং এর থিওরি অব এভ্রিথিং।
আবার ব্যাপক আপেক্ষবাদ এর আরেকটি ভবিষ্যৎবানী হল,পারমানবিক জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে বৃহৎ ভরসম্পন্ন তারকাগুলি নিজেদের  উপর চুপসে যাবে এবং যতক্ষন পর্যন্ত তারা অসীম ঘনত্বের অনন্যতায় না পৌছায় ততক্ষন পর্যন্ত চুপসে যেতেই থাবে এবং একসময় হবে কালের সমাপ্তি। আর এই অনন্যতার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত শক্তিশালী হবে যে আলোক তার নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে বের হতে পারবে না বরং আলোককে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র পিছনে টেনে রাখবে। যে অঞ্চল থেকে নিষ্ক্রমন সম্ভব নয় তাকেই বলে ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর।
ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর ও হকিং বিকিরণ
১৯৭৩ সালে সেপ্টেম্বরে ইয়াকভ জেল্ডোভিচ এবং আলেকজান্ডার স্টারোবিনস্কি নামে দুজন সোভিয়েত বিজ্ঞানীর সাথে স্টিফেন হকিং এর কথা হয় কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে। তারা বলেন কৃষ্ণগহ্বর এ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূত্র প্রয়োগ করে দেখা যায় যে কৃষ্ণগহ্বর থেকেও বিকিরণ বের হতে পারে। কিন্তু তাদের গাণিতিক যুক্তি হকিং এর পছন্দ হয়নি। হকিং নিজে গানিতিক কাঠামো নির্মাণ করেন। কৃষ্ণগহ্বর থেকে  কনিকা বের হওয়া কেমন করে সম্ভব? তার উত্তর দিয়েছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। কৃষ্ণগহ্বর এর প্রধানত দুটি অঞ্চল থাকে একটি হল অনন্যতার অঞ্চল ও আরেকটি ঘটনা দিগন্ত। আরঘটনা দিগন্তের বাইরের দিকে থাকে শুন্য অঞ্চল। অনন্যতার অঞ্চলে যেখানে অসীম ঘনত্ব বিশিষ্ট থাকে এবং কোন কিছুই বের হতে পারে না প্রবল মহাকর্ষীয় বলের কারনে। আর ঘটনা দিগন্ত হচ্ছে আলোকিত অঞ্চল যেখানে আলোক কনাকে প্রতিনিয়ত টেনে রাখছে কৃষ্ণগহ্বর এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র। আর এই ঘটনা দিগন্তগুলোর  বাহিরের দিকের শূন্য অঞ্চল আসলে শূন্য হতে পারে না। কিন্তু অনিশচয়তার নীতি অনুযায়ী সমস্ত রাশিগুলোর একটির সম্পর্কে যত নিখুঁত ভাবে জানা যায় অপরটি সম্পর্কে ততই কম নিখুঁত জ্ঞান প্রাপ্ত হয়। তাই পরম শূন্য বলে কিছু নেই। মহাকর্ষ বহন কারী কনিকা গুলো তাই জোড় হিসেবে ভাবা যায়। পরষ্পরের ক্রিয়ায় শূন্য হয়ে যায়। আবার কোন এক সময় তারা এক সাথে দেখা দেয় বা কোন কোন কোন সময় আলাদা হয়ে দেখা যায়। আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি ভবিষ্যদ্বানী হল, কনিকার সমরূপ জোড় দেখা যাবে। যার একটি হবে কনিকা আরেকটি হবে বিপরীত কনিকা। যেহেতু শূন্য থেকে শক্তি সৃষ্টি হতে পারে না সেইজন্য কনিকা ও বিপরীত কনিকার একটি হবে পজিটিভ চার্জ যুক্ত এবং অন্যটি হবে নেগেটিভ চার্জ যুক্ত। এসব কনা শক্তি অবস্থায় থাকে। আমরা যেসব কনাগুলো পর্যবেক্ষন করি তা পজিটিভ শক্তি সম্পন্ন। কিন্ত ব্লাক হোল এর ভিতরে মহাকর্ষীয় বল এত পরিমানে থেকে যে পজিটিভ ও নেগেটিভ এ দুই শক্তি অবস্থায় থাকতে পারে। এর মধ্যে নেগেটিভ শক্তি সম্পন্ন কনা ব্লাক হোল এ পতিত হয় আর কেউ যদি দূর থেকে পর্যবেক্ষন করেন তাহলে পজিটিভ শক্তিসম্পন্ন কণার অস্তিস্ত্ব পেতে পারেন। একেই হকিং রেডিয়েশন বলা হয়। তবে এগুলো এখনো তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা, পর্যবেক্ষনলব্ধ ব্যাখ্যা অতিশীঘ্রই পাবো আশা করি আমরা।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি বিচারে হকিং
একজন বিজ্ঞানীর বিজ্ঞান সাধনা শুধু তার চার দেয়ালের ল্যাবরেটরী বা কিছু ধ্রুবক সম্মলিত সমীকরনে আবদ্ধ থাকে না , তার প্রকৃতির ঘটনা গুলোকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ,তার বিশ্লেষণ এবং ফলাফল  এসবের প্রতি স্পষ্ট ধারনা থাকতে হয়। বিজ্ঞানের সর্বব্যাপী সামাজিক দায়বোধ থেকেই এবং বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ার পিছনে একজন বিজ্ঞানীর ভূমিকা খুবই গুরত্বপূর্ন। হকিং তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও সে কাজ গুলো করে গেছেন। হকিং পর্যবেক্ষন লব্ধ জ্ঞান এবং যুক্তিবাদী মননের ছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাসের চেয়ে তিনি গুরুত্ব দিতেন বিজ্ঞান ও গনিতের বিষয় গুলোকে। তিনি বলেছেন, “আমরা যাকে বাস্তব বলি সেটা নির্ভর করে আমরা যাকে  তত্ত্ব বলি তার উপরে, তাহলে আমরা বাস্তবতাকে কি করে দর্শনের ভিত্তি করব? আমি বলব সামনে একটা মহাবিশ্ব রয়েছে এবং সেটা অপেক্ষা করছে তার সম্পর্কে অনুসন্ধান করার জন্য এবং তাকে বোঝার জন্য এই অর্থে আমি একজন বাস্তববাদী।”স্টিফেন হকিং বরাবরই নিয়তি বা ভাগ্যের পরিবর্তে বিবেচনাবোধ ও কাজের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। নিয়তি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যটিও বেশ সুস্পষ্ট। ‘ব্ল্যাক হোলস অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার এসেস’-এ তিনি লিখেছেন, ‘আমি দেখেছি যে এমনকি যেসব মানুষ মনে করে সবই পূর্বনির্ধারিত এবং মানুষের কিছুই করার নেই, তারাও রাস্তার পার হওয়ার সময় আশপাশটা ভালো করে দেখে নেয়   হকিং শুরু থেকেই মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে যেসব ধর্মীয় ব্যখ্যা এবং মানুষের মনন জগৎ গড়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গড়ে তোলার লক্ষে চেষ্টা করেছেন । তিনি মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য পবিত্র ধর্মগ্রন্থের কাল্পনিক বর্ননা থেকে বেড়িয়ে  সর্বসাধারনের কাছে পৌছানোর জন্য লিখেন ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’(A Brief History Of Time) যা অক্সফোর্ডের প্রকাশনার ইতিহাসে ২য় সর্বোচ্চ বিক্রিত বই। তাকে সমসময়ই জিজ্ঞাসা করা হয়েছে মহাবিশ্বের সৃষ্টির বা চালনার  জন্য ঈশ্বর এর প্রয়োজন রয়েছে কিনা? তিনি তার ‘গ্রান্ড ডিজাইন’ বইটিতে স্পষ্ট করে বলেছেন, “মহাবিশ্বকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই  জীবনের সর্বত্র বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা করতেন তিনি। তাই হয়ত তিনি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা দিয়ে বেচে ছিলেন ৭৬ বছর মৃত্যু সম্পর্কে বলেছেন, ‘মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। মরার জন্য আমার কোনো তাড়াহুড়াও নেই। তার আগেই বহু কিছু করার আছে আমার। আমার কাছে মস্তিষ্ক হচ্ছে কম্পিউটারের মতো, যার সরঞ্জামগুলো নষ্ট হলেই সে আর কাজ করবে না। আর একটি নষ্ট কম্পিউটারের জন্য কোনো স্বর্গ বা নরক অপেক্ষায় থাকে না। অন্ধকারে ভয় পাওয়া মানুষের জন্য নির্মিত এক কাল্পনিক গল্প এটি     

অনন্য মানবিক সত্তার বিজ্ঞানী
ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশ এ  বড় হন স্টিফেন,তার মা ইসাবেলা বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে কমিউনিস্ট না হলেও বাম পন্থার প্রতি তার সমর্থন সব সময়ই ছিল।বিজ্ঞানে র বাহিরে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তার কর্মকাণ্ড ছিল ব্যাপক। কিজ কলেজে কোন মেয়েকে ভর্তি করানো হত না। এ নিয়ম পরিবর্তন এর জন্য এক দশকব্যাপী আন্দোলন এ নেতৃত্ব দিয়েছেন হকিং। তার প্রথম স্ত্রী জেন এবং তিনি লেবার পার্টির সদস্য হিসেবে গরীব,শোষিত ও শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করেন। এছাড়া তিনি আনবিক অস্ত্র উৎপাদন বিরোধী ছিলেন।
যখনই সাম্রাজ্যবাদের কবলে কোন দেশে আক্রান্ত হয়েছে তিনি ছুটে চলেছেন হয়তো সব সময় সশরীরে পারেননি কিন্তু প্রতিবাদ করেছেন কখনো লিখে বা কোন বড় বিজ্ঞান সম্মেলন বর্জন করে প্রতিকী প্রতিবাদ হিসেবে। ভিয়েতনাম  এ বর্বরচিত মার্কিন আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন।
২০০৪ সালে ইরাক আক্রমণের বিরুদ্ধে লেখক,সাধারন ছাত্র-ছাত্রী,রাজনীতিবিদদের সাথে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে  আয়োজিত মৃত্যু ইরাকিদের নাম স্মরন ও প্রতিবাদ সভায় অংশগ্রহন করেন। যেখানে ইরাকে মার্কিনের আক্রমণের দুটি কারনের একটি ছিল ইরাকে মারাত্মক অস্ত্রসস্ত্র এবং ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর এ টুইন টাওয়ার আক্রমণ। সেখানে তিনি তার কৃত্রিম যান্ত্রিক ভয়েস এ বলেন, “যুদ্ধ দুটি মিথ্যার উপর সংগঠিত হচ্ছে”। তিনি আরো বলেন, “ আমি দুঃখিত আমার উচ্চারন এর জন্য। আমার স্পিচ সিন্থেসিসার ( speech synthesiser ) ইরাকিদের নাম উচ্চারনের জন্য তৈরি করা হয় নি”।
২০১৩ সালের কথা। গাজায় তখন ইসরায়েল অনবরত বোমা ফেলে চলছে। ঘর বাড়ি স্কুল কলেজ থেকে শুরু সব কিছুর ধ্বংস যোজ্ঞ করে চলেছে ইসরায়েল, আমেরিকার খুটির জোরকে পুজি করে। এমন সময় জের‍্যজালেম বিশ্ববিদ্যালয় এ হতে চলেছিল মহাবিশ্বতত্ত্বের উপর এক বিশ্ব সম্মেলন। প্রধান অতিথি হুইলচেয়ারের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হকিং। তিনি বলে বসলেন, “আমি যাচ্ছি না। ঐ অসভ্য দেশের বিজ্ঞান নিয়ে সম্মেলন করার অঢিকার নেই”। স্পেন,ফ্রান্স,হল্যান্ড সহ অন্যান দেশের বিজ্ঞানীরাও এই  সম্মেলন বর্জন করলেন। এমনি উচু মানের বড় মানুষ ছিলেন তিনি।
তার হুইল চেয়ারে জীবনযাপন প্রতিবন্ধীদের বড় অনুপ্রেরনা তা সত্ত্বেও তিনি প্রতিবন্ধীদের সহোযোগীতা করতেন ও তাদের সুযোগ সুবিধা নিয়েও আন্দোলন করেছেন। কেম্ব্রিজ কলেজে প্রতিবন্ধীদের জন্য ছাত্রাবাস নির্মান করেন তিনি যেটা হকিং হাঊস নামে পরিচিত।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান মনোনয়ন পাওয়ার পর ব্যাপক শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ট্রাম্পের মস্তিষ্কই শঙ্কার কারণ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। এই শঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা এখন দৃশ্যমান। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর এ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস(NHS),ইংল্যান্ড কে অতিমাত্রায় বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এ উন্নীত করা হয়। তিনি এর প্রতিবাদ করেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি সমাজের এবং বিজ্ঞানের সাধনা করে গেছেন।
আমাদের ভবিষ্যৎ পৃথিবী
স্টিফেন হকিং সবসময় পৃথিবীর এবং আমাদের সমাজের এবং  মানব সভ্যাতার পরিনতি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক মনন কাঠামো গড়ে না ঊঠায় হকিং খুবই চিন্তিত ছিলেন। কোন একজন ক্ষ্যাপাটে হিটলারের এক সুইচ এর চাপেই শেষ হয়ে যেতে পারে আমাদের এই সুন্দর সভ্যতা। একদিকে কিছু মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমছে এবং বড় বড় ধনী দেশ গুলো অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলো থেকে শোষণ করতে যুদ্ধ বাধিয়ে চলছে। সে ক্ষেত্রের ব্যাবহার হচ্ছে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের ঘাম ঝরানো আবিষ্কার যা কিনা মানব সভ্যতার কল্যানে হওয়ার কথা ছিল। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে খুবই শংকিত ছিলেন। “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসংস্থানে ধস নামিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে উঠেছে, এসব প্রযুক্তি সেই বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ইন্টারনেট এবং আরও কিছু ক্ষেত্র খুব ছোট ছোট গ্রুপে থাকা লোকজনকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে চাকরির সুযোগ পাচ্ছে খুবই কমসংখ্যক মানুষ। এটি অবশ্যম্ভাবী যে এতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হলেও এটি সামাজিকভাবে ধ্বংসাত্মক পরিণতি আনছে”।মানুষ আদিম কাল থেকেই তার এবং তার আশে পাশের জগতের বর্ননা  করতে চেয়েছে,প্রশ্ন করেছে  কি? কেন? কিভাবে? এসব হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশ এ টিকে থাকার  দ্যোতনা মানুষ কে জুগিয়েছে জ্ঞান অর্জনের রসদ। ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে সংগ্রামের ফসল যা আমাদের আজকের বড়বড় ইকুয়েশন এবং বড় বড় বই। সেই সংগ্রামের বড় বড় সৈনিক আমাদের সাধারন মানুষ কৃষক, শ্রমিক ও একদল মানুষ যারা সত্য খুঁজে বেড়িয়েছে তাদের জীবন দিয়ে। সেই বিজ্ঞান আজ হাতিয়ার হয়েছে কিছু মুনাফা লোভী মানুষের। এসবের বিরুদ্ধে চিরকালই সংগ্রাম করে গেছেন হকিং। পদার্থ বিজ্ঞানের দিকপাল বিজ্ঞান সাধক হকিং চলে গেলেন ১৪ মার্চ ঠিক আইনস্টাইন এর ১৩৯ জন্মবার্ষিকীতে। হুইলচেয়ারের এই বিজ্ঞানী মানুষকে বাচতে শিখিয়েছেন, বিজ্ঞানের এবং সমাজের জন্য বেচেঁছেন, তার এই জীবনকর্ম ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।
তথ্য সূত্রঃ
১. A brief History of Time(1988) by Stephen W. Hawking
২. Black Holes and Baby Universes and Other Essays (1993) by Stephen W. Hawking
৩. The Grand Design  by Stephen W. Hawking and Leonard Mlodinow  (2010)
৪. Stephen W. Hawking A biography by Kristine Larsen(2007)



Post a Comment

0 Comments