লিখেছেন
সৌরভ সিংহ
কেমন যাবে আপনার দিনটি? ঘুম থেকে উঠেই এক কাপ চা হাতে নিয়ে দৈনিক
পত্রিকার রাশিফল পাতাটি খুললেই চিচিং ফাক,আপনার সারাদিন আপনার হাতের মুঠোয়
।এমনকি আপনার বিয়ে,চাকুরী
প্রাপ্তি,দাম্পত্য জীবন,অর্থযোগ,ব্যবসায় লাভ লোকসান এর খবরাখবর। আমদের বিখ্যাত দৈনিকগুলোতে বা টিভি চ্যানেল এ
অনেক জরুরী খবর বাদ গেলেও রাশিফল(horoscope) এর কলামটি বা প্রোগ্রামটি বাদ
যায় না। কারণ,মানুষের অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ও বিশ্বাস যেটা কিছু মানুষকে ব্যবসার
সুযোগ করে দেয়। আমেরিকার “ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন(NSF)”
এর ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী শতকরা ৪৫ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান “জ্যোতিষশাস্ত্র(ASTROLOGY)” কে একপ্রকার বিজ্ঞান মনে
করে ।আর সে দেশে ক্রিয়াশীল জ্যোতিষীদের সংখ্যা লাখের উপরে। বিজ্ঞানমনষ্ক যেকোন
মানুষই আঁতকে উঠবেন এই রিপোর্ট দেখে যেখানে এত বড় বড় মহাকাশ গবেষনার বিষয়গুলো আমেরিকান
বিজ্ঞানীরা সফলতার সাথে পরিচালনা করছেন সেখানে এস্ট্রলজি বা জ্যোতিষশাস্ত্রের মত
অপবিজ্ঞান(pseudoscience) এ মানুষের এত বিশ্বাস
কেন?? স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বিজ্ঞান কি তাহলে গুটিকয়েক মানুষের হাতে ?? কয়েকশ বছর
আগেও এই জ্যোতিষীদের শুধু রাষ্ট্রই নিয়োগ দিত।
তারা রাজাদের ভাগ্য, রাজবংশের স্থায়িত্ব ও সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ গননা
করত।আরো মজার বিষয় নিয়োগপ্রাপ্ত জ্যোতিষী ছাড়া অন্য কেউ জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করলে
তাদের মৃত্যুর বিধান ছিল ।কেন? কারণ সাম্রাজ্যের পতন ঘটানো সহজ যদি আগেই সেটা
অনুমান করা যায়।এমনকি চীনা জ্যোতিষীরা ভুল গণনা করলে তাদের মৃত্যুর বিধান পর্যন্ত
ছিল। জ্যোতিষবিদ্যা জিনিষটি অদ্ভুত এক শাস্ত্রে পরিনত হয় যেখানে সতর্ক
পর্যবেক্ষন,গনিত,দলিল সংরক্ষন,আর অসপষ্ট চিন্তাভাবনা আর ধর্মীয় ভন্ডামি।
জ্যোতিষশাস্ত্রের ইতিহাসঃ
আদিম সমাজ থেকেই গ্রহ নক্ষত্রের উপর
মানুষের নির্ভরশীলতা ছিল। মানুষ রাতে পথ চেনার জন্য তারার অবস্থান এর উপর নির্ভর
করত, আকাশের গায়ে বিভিন্ন ধরনের নক্ষত্রপুঞ্জের(constellations) নকশা কল্পনা করে তারা
গুহার অবস্থান নির্নয় করত। মানব সভ্যতা কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রবেশ এর পরেই কৃষিকাজ এর জন্য সূর্য –নক্ষত্রের অবস্থানের
উপর ঋতু পরিবর্তন বুঝে নেয়ার প্রচলন শুরু
হয়।ধারনা করা যায় সেখান থেকেই জ্যোতিষশাস্ত্র শুরু শুধু জ্যোতিষশাস্ত্রই না
জ্যোতির্বিজ্ঞান(Astronomy) এর যাত্রাও এরই
সাথে।
জ্যোতির্বিজ্ঞান বিজ্ঞান এর অন্যান্য শাখার মত একসময় অপবিজ্ঞান ছিল
।যেমন,কেমিস্ট্রি মানে রসায়ন যা আলকেমি বিদ্যার সাথে সম্পৃক্ত ছিল যেখানে বিভিন্ন
ধাতু কে সোনা বা অন্য কোন মূল্যবান ধাতুতে রুপান্তর এর পদ্ধতি বর্ননা করা হত।কারণ
প্রাচীন কালে পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা ও গাণিতিক হিসাব পদ্ধতি অনুন্নত থাকার ফলে
সে সময় ব্যক্তি বিশ্বাসের সাথে পর্যবেক্ষণ তালগোল পাকিয়ে এ ধরনের অপ বিজ্ঞানের
জন্ম নেয় । সে সময়কার মানুষরা
পর্যবেক্ষণ করেছিল যে বিভিন্ন নক্ষত্রের বিভিন্ন অবস্থান শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষার পূর্বাভাস দেয়।যেমন
মিশরের নীলনদ এর বন্যা বছরের ৪ মাস হত এবং সেই বন্যার পলিতে মাটি উর্বর হত এবং ফসল
ভালো হত। সূর্যের একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্রমন্ডলে অবস্থান এই বন্যার সময় নির্দেশ
করত। তাই তারা নক্ষত্রের ও নক্ষত্রমণ্ডলের গতি প্রকৃতি ও আকৃতি কাঠামোবদ্ধ করে ঋতু
গননার কাজে ব্যাবহার করত।ক্রমেই এই সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রের অবস্থান তাদের ধর্মীয়
,সামাজিক রীতিনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।তৈরি হয় সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্রের
অবস্থানের উপর নির্ভর করে বর্ষপঞ্জি। আজকের বর্ষপঞ্জি প্রধানত মিশরীয়দের অবদান।কোথাও তৈরি হয় সৌর
বর্ষপঞ্জি আবার কোথাও চন্দ্র বর্ষপঞ্জি । এই সুমেরীয় ও ব্যাবীলনয়ীরাই প্রথম বছরকে
১২ ভাগে বা মাস এ বিভক্ত করেনএবং বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন নক্ষত্রমন্ডলীর অবস্থান এর
উপর নির্ভর করে ৭০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে সর্বপ্রথম রাশিফল প্রণয়ন করেন।এছাড়া
ব্যাবিলনীয়ানরা ৭৮৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেই তখনকার আবিষ্কৃত পাঁচটি গ্রহের সুশৃঙ্খল ও
ধারাবাহিক তালিকা প্রণয়ন করেন ।এর প্রায় ৯০০ বছর পর এই তালিকা ব্যাবহার করে টলেমী
গণিত সহযোগে ভূকেন্দ্রিক মানে পৃথিবী কেন্দ্রিক বিশ্ব মডেলের ধারনা দেন।
কোপার্নিকাস এর পূর্ব পর্যন্ত এই মডেল এর
প্রভাব ছিল আকাশচুম্বী।টলেমীর এর পৃথিবীকেন্দ্রিক মডেল যেমন একদিকে
জ্যোতির্বিজ্ঞান এর স্তম্ভ হয়ে দাড়িয়েছিল অন্য দিকে জ্যোতিষশাস্ত্রের ভিত্তি
হিসেবে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। একদিকে তার “আলমেজেস্ট”
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক অনন্য গ্রন্থ অপরদিকে তাঁর “টেট্রাবিবলস” জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি প্রামাণ্য
গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ,বলতে গেলে এটি জ্যোতিষীদের কাছে
বাইবেলের মত।অর্থাৎ সে সময় একি ব্যক্তি এক সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র
চর্চা করত।প্রাচীন ভারতের দিকে তাকালেও আমরা একি চিত্র দেখতে পাই।বরাহ মিহিরের(৫০৫-৫৮৭
খ্রিষ্টাব্দ) “সিদ্ধান্ত” যেমন গ্রহ,নক্ষত্র,সূর্যগ্রহণ বিষয়ক গণিত সম্বলিত গ্রন্থ তেমনি
“হোরা” হল ভাগ্য গণনা ,যাত্রার শুভ-অশুভ বলে দেওয়ার অপ বিজ্ঞান ।তবে টলেমীর পৃথিবীকেন্দ্রিক মডেল
বাতিল হয়ে যায় ষোড়শ শতাব্দীতে কোপার্নিকাস এর সূর্যকেন্দ্রিক মডেল এবং পরবর্তীতে
কেপলার এর “বাহ্যিক বলের প্রভাবে গ্রহগুলোর ঘূর্নন” ব্যাখার মধ্য দিয়ে। পর্যবেক্ষণ
ও গাণিতিক হিসেব পদ্ধতির উন্নতির সাথে সাথে কোপার্নিকাস,টাইকো,কেপলার,গ্যালিলিওদের হাত ধরে ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের
মাধম্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান তাঁর আজকের অবস্থানে এসেছে। অপরপক্ষে ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র
বিলোপ এবং জ্যোতিষীদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় উপস্থিতি ,কদর
হ্রাস পেতে থাকলে এই শাস্ত্রটির ব্যাপক ভাবে সামাজিকীকরণ ঘটে ।
নক্ষত্র পুঞ্জের বিভিন্ন আকৃতি |
রাশিচক্রঃ
ইংরেজী Zodiac (রাশিচক্র) শব্দটি
পাওয়া যায় গ্রীক শব্দ zōidiakòs
kýklos থেকে যার অর্থ হচ্ছে “ ছোট পশুদের বৃত্ত”।এই
রাশি চক্র বুঝতে হলে আমাদের কিছু বিষয় জানা জরুরী।আমরা সকলেই জানি যে পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারনেই প্রতিদিন সূর্য
পুর্ব দিকে
উদয় হয় পশ্চিমে অস্ত যায়।এখন আমাদের এই বিশাল অর্ধগোলকাকৃতি যে
আকাশটিতে সূর্য চন্দ্র ও অন্যান্য জ্যোতিষ্ক গুলো দেখা যায় সেটাকে যদি একটি গোলক
চিন্তা করি তবে সেটাকে বলা হবে খ-গোলক ।এই খ-গোলক বরাবর সূর্য ,চন্দ্র ও জ্যোতিষ্কগুলি বছরে একটি নিদিষ্ট পথে পরিভ্রমণ
করছে। খ-গোলোকে সূর্যের ভ্রমণপথকে বলা হয় ক্রান্তিবৃত্ত ।আর মাঝ বরাবর পৃথিবীর
বৃত্তকে বিষুববৃত্ত বলা হয়। যদি পৃথিবী ২৩.৫ ডিগ্রি কোনে হেলে না থাকত তাহলে
পৃথিবীর বিষুববৃত্তই হত এর ক্রান্তি বৃত্ত ।এখন আমরা এই ক্রান্তিবৃত্ত হতে উত্তর ও
দক্ষিণে ৯ ডিগ্রি করে ১৮ ডিগ্রি চওড়া ব্রেসলেটের ন্যায় আকাশের এই অংশটি আলাদা ভাবে
লক্ষ করি, তাহলে দেখা যাবে সারা বছরে পর্যায়ক্রমে আকাশের ৮৮
টি নক্ষত্র মণ্ডলের ১২ টি নক্ষত্রমণ্ডল বৃত্তাকার ব্রেসলেটের ন্যায় অংশটিতে
অবস্থান করে । চওড়া বৃত্তাকার ব্রেসলেটের ন্যায় আকাশের এই অংশটিকে বলা হয়
ক্রান্তিবলয় ।চন্দ্র ও কিছু গ্রহের ভ্রমনপথও এই ক্রান্তি বলয়ের মধ্যে। রাতের আকাশে
এই ক্রান্তিবলয়ে মাস ভেদে এই ১২ টি নক্ষত্রমণ্ডলের ধারাবাহিক অবস্থান আমরা দেখতে
পাই।প্রাচীন জ্যোতির্বিদরা এই ক্রান্তিবলয়কে ৩০ ডিগ্রি করে ১২ টি নক্ষত্রমণ্ডলের
জন্য ১২ টি ভাগে ভাগ করে।একেই তারা রাশিচক্র হিসেবে অভিহিত করেছিল । এই
ক্রান্তিবলয় বরাবর সূর্যের, দিনে প্রায় ১ ডিগ্রী করে সরণের ফলে সূর্য সে সময়
প্রতিটি রাশিতে প্রায় ৩০ দিন করে অবস্থান। সেকারনে প্রাচীন কালে রাশিচক্র সময় ,মাস জানার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ন ছিল।আর এই রাশিচক্রই আজ জ্যোতিষ শাস্ত্রে
ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।রাশিচক্রের নামঃ
রাশিগুলোর নাম এমন অদ্ভুত কেন ? আগেই
বলে হয়েছে যে বিভিন্ন নক্ষত্র মন্ডলে বা রাশিতে সূর্যের একটি নির্দিষ্ট সময়
পর্যন্ত অবস্থান এর উপর ভিত্তি করেই এই রাশিচক্র তাই এই রাশি গুলোর নাম দেয়া হয় নক্ষত্র মন্ডলে অবস্থিত
তারাগুলোর একটি প্যটার্ন বা আকৃতি কল্পনা করে। প্রাচীন মিশরে এই প্যটার্ন গুলোর নাম
দেয়া হত তাদের দৈনন্দিন জীবনে মিলে যায় এমন কোন পশুর আকৃতির সাথে মিল রেখে বা
দেব-দেবীর অবয়ব বা কোন পৌরানিক ঘটনার সাথে মিল রেখে পরবর্তীতে গ্রীকে এই রশিগুলোর
নামের অনেক পরিবর্তন হয়। ১২টি রাশির নাম যেমন, মেষ(Aries) , বৃষ(Taurus), মিথুন(Gemini), কর্কট(Cancer), সিংহ(Leo), কন্যা(Virgo), তুলা(Libra), বৃশ্চিক(Scorpio), ধনু(Sagittarius), মকর(Capricon), কুম্ভ(Aquarius), মীন(Pisces)
জ্যোতিষশাস্ত্র কি
বিজ্ঞান?
১.পত্রিকায় রাশিফল বিভাগে
প্রথম যে রাশিটি আমরা দেখি তা হল মেষ রাশি(২১ মার্চ
থেকে ২০ এপ্রিল)।মজার ব্যাপার হল বর্তমান শতকে এই সময়ে সূর্য মেষ রাশিতে নয় বরং তা
মীন রাশিতে অবস্থান করে এই গোলমাল অন্যান্য রাশির ক্ষেত্রেও একই রকম।এই গোলমালের মূল কারণ
হচ্ছে পৃথিবীর “অয়নচলন”। আমরা জানি বিষুববৃত্ত
ও ক্রান্তিবৃত্ত ২৩.৫ ডিগ্রী কোনে পৃথক রয়েছে
এবং এই বৃত্ত দুটি পরস্পরকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে। এই বিন্দু দুটিকে বলাহয় মহাবিষুব
এবং জলবিষুব বিন্দু। সহজ ভাবে বলতে খ-গোলকে এই দুটি
বিন্দু হচ্ছে বছরে দুইদিন বিষুববৃত্তের উপর সূর্যের অবস্থান। এ দুই দিন হচ্ছে ২১ শে
মার্চ(দিন রাত্রি সমান) এবং ২৩ শে সেপ্টেম্বর। মহাবিষুব বিন্দুকে ক্রান্তিবৃত্তের শূন্য ডিগ্রী বিন্দু
বা প্রারম্ভ বিন্দু ধরা হয়। এ কারণে ২০০০ বছর আগে ২১ শে মার্চ এই মহা বিষুববিন্দু হতে পরবর্তী
৩০ ডিগ্রী পর্যন্ত সূর্য মেষ রাশিতে অবস্থান করত বলেই মেষ রাশিকে রাশিচক্রের প্রথম
রাশি ধরা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রতিবছর এই বিষুব বিন্দু দ্বয় তাদের অবস্থান পরিবর্তন
করছে। প্রতি ৭২ বছরে এই বিন্দু
দুটির ১ ডিগ্রী করে অগ্রগমন ঘটে এবং বর্তমান অবস্থায় ফিরে আসতে তাদের ঠিক ২৬০০০ বছর
লাগবে। বিষুব বিন্দু দ্বয়ের এই চলনকেই অয়নচলন বলে। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন এমনটি
ঘটে ?এর কারণ হচ্ছে পৃথিবীর ঘূর্নণ অক্ষের
স্বল্প গতির ঘূর্নণ। পৃথিবী যেমন নিজ অক্ষে ঘুরে চলছে তেমনি এর ঘুর্নন অক্ষটিও নিজ অবস্থান
থেকে নিয়ম মাফিক সরে যাচ্ছে। এই ঘূর্ননঅক্ষটি প্রতি ২৬০০০
বছরে চিত্রের ন্যায় একবার পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের এই সরণের
ফলে ক্রান্তিবৃত্তেরও সরণ ঘটছে এবং এর ফলেই বিষুব বিন্দু দ্বয়ের সরণ বা “অয়নচলন” ঘটছে। ঘূর্ণন অক্ষের সরণের
ফলে কিছু চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটে। যেমন আমরা উত্তর আকাশে বর্তমানে যে স্থানে ধ্রুবতারা দেখি ১৩০০০
বছর পর সেখানে বীণা মণ্ডলের অভিজিৎ নক্ষত্রটিকে দেখা যাবে এবং এরও ১৩০০০ বছর পর সেখানে
পুনরায় ধ্রুবতারাকে দেখা যাবে। যাহোক হয়ত একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে অয়নচলনের সাথে রাশিচক্রের রাশির অবস্থান
পরিবর্তনের সম্পর্ক টা কি?সম্পর্ক টা বেশ
সহজ। আজ থেকে ২০০০ বছর আগের কোন এক সময় রাশিচক্র তৈরি হয়
তখন সূর্য ২১ মার্চ তারিখে সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করত যা আগেই বলা হয়েছে। যা টলেমীর “টেট্রাবিবলস” হতে জানা যায়। টলেমী তাঁর “টেট্রাবিবলস” এ বলেছেন “সূর্য তখন ২১ শে মার্চ তারিখে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে এবং ২২ এপ্রিল পর্যন্ত
সেখানেই অবস্থান করত”। কিন্তু আজ ২০০০ বছর পর মহাবিষুব বিন্দুর প্রায় ২৭ ডিগ্রী সরণের ফলে
সূর্য এখন ২১ শে মার্চ মীন রাশিতে(নক্ষত্রমণ্ডল)
প্রবেশ করে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করে এবং ১৪ই এপ্রিলে গিয়ে
সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। রাশিচক্রের অন্যান্য
রাশির ক্ষেত্রে একই অবস্থা এবং রাশি গুলোতে সূর্যের অবস্থানের সময় কালেরও ব্যাপক পরিবর্তন
হয়েছে। যেমন সূর্য কন্যা রাশিতে অবস্থান করে ৪৪ দিন আবার বৃশ্চিক রাশিতে
অবস্থান করে মাত্র ৭ দিন। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে জন্মমুহুর্তে
সূর্যের অবস্থানই মানুষের রাশি নির্ধারন করে। এই শাস্ত্র মতে ১ আগস্ট জন্ম গ্রহণকারী হবে সিংহ রাশির তবে বর্তমানে এই দিন
সূর্য অবস্থান করে কর্কট রাশিতে। তার মানে একই ব্যাক্তি এক সাথে পৃথক দু ধরনের ভাগ্যর
অধিকারী ! আরও
মজার ব্যাপার হল কারো জন্ম যদি ২৯ নভেম্বর থেকে ১৮ই ডিসেম্বরের মধ্যে হয় তাহলে তার
জন্য বর্তমানে রাশিচক্রের কোন রাশিই বরাদ্দ নেই কারণ এই সময় সূর্য সর্পধারী নক্ষত্রমণ্ডলে
অবস্থান করে। তাই কারো সাথে যদি পত্রিকার রাশিফল বা কোন জ্যোতিষীর ভবিষৎবাণী কাকতালীয়
ভাবে মিলেও যায় তবে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোন কারণ নেই ,কারণ আপনি নিজেকে যে রাশির জানেন আদতে আপনি মোটেও সেই রাশির
নন।
২.আমরা জানি সূর্যের একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্রমন্ডলী
অতিক্রম করতে যে সময় লাগে সেটাই এক একটি রাশি তাই বছরকে ১২ টি ভাগে ভাগ করে
রাশিচক্র তৈরি করা হয়। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে সবচেয়ে ছোট নক্ষত্রমন্ডলী বা রাশি
বৃশ্চিক বা Scorpio অতিক্রম
করতে সূর্যের সময় লাগে ৭ দিন । অপর পক্ষে সবচেয়ে বড় নক্ষত্রমন্ডল কন্যা বা Virgo অতিক্রম করতে সময় লাগে ৪৪ দিন। সেক্ষেত্রে কখনোই সমান ১২ ভাগে ভাগ করা সম্ভব
না।
৩.বাস্তবিক অর্থে গ্রহ,নক্ষত্র গুলোর কোন শক্তি বা বলের এমন কোন প্রভাবই নেই যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ
করে। আর পৃথিবীর উপর যদি কোন বলের প্রভাব থেকে থাকে তা হল মহাকর্ষীয় বল। তবে গ্রহ,নক্ষত্র গুলো পৃথিবী হতে এত দূরে যে তারা পৃথিবীর উপর মহাকর্ষীয়
বা অভিকর্ষ জনিত যে বল বা শক্তি প্রয়োগ করে তার পরিমাণ অতি নগণ্য। তাই কারো জন্ম মুহূর্তে
গ্রহ-নক্ষত্রের আকর্ষণ বলের ক্রিয়া জন্মগ্রহণ
কারীর ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করছে এমনটি ভাবার কোন যুক্তি নেই।
৪.জ্যোতিষশাস্ত্রে ভাগ্যগননার
আর একটি বড় উপাদান হল গ্রহ ও তাদের অবস্থান। শাস্ত্রমতে গ্রহ নক্ষত্রদের
সময় ভেদে অবস্থানের উপরেই নাকি ব্যবসার লাভক্ষতি,বিদেশ
গমন ,পরীক্ষায় ছাড়াও ইহ জাগতিক সকল কর্ম নির্ভর করে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত
গ্রহের সংখ্যা হাজারেরও উপরে আর সেখানে জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনায় আছে শুধুমাত্র প্রাচীন
পৃথিবীর আবিষ্কৃত সেই ৫টি গ্রহ। আর ইউরেনাস ও নেপচুনকে তাদের এই গণনায় খুঁজে পাওয়া না
গেলেও রাহু কেতু নামে দুটি কাল্পনিক গ্রহকে তাদের গণনায় পাওয়া যায়। মজার বিষয় হচ্ছে মহাবিশ্বের
এত গ্রহের মাঝে জ্যোতিষীরা গ্রহ স্বল্পতায় পরে সূর্যকে একটি গ্রহ হিসেবেই বিবেচনা করে!
৫.উপরের চিত্র টি লক্ষ করি। প্রথম ছবিটি হল সিংহ
নক্ষত্র মণ্ডলের। কয়েক মিলিয়ন বছর পরে সিংহ মণ্ডলের নক্ষত্রগুলো ২য় চিত্রের ন্যায়
বিন্যস্ত হবে। ২য় চিত্রের নক্ষত্র গুলো নিয়ে কি কোন চিত্র কল্পনা করা যায়?দেখুনতো রাডার বা ভূ-কৃত্রিম উপগ্রহ কল্পনা
করা যায় কিনা। তাঁর মানে কি কয়েক মিলিয়ন বছর পর কিছু মানুষের আচরণ ,বৈশিষ্ট্য কি ভূ-কৃত্রিম উপগ্রহের ন্যায়
হওয়া উচিত ?
জ্যোতিষীদের দাবি অনুযায়ী
গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে । রাশিগুলোর
নামকরণ এর পিছনের যে ইতিহাস এর উপর ভিত্তি
করে মানুষের আচার আচরন নির্ধারণ করা কতটা অবৈজ্ঞানিক তা আজকে বিজ্ঞান এর চরম
উৎকর্ষের যুগে খুব সহজেই বোঝা যায়।দুটি পত্রিকার রাশিফল দুরকম এখন প্রশ্ন জাগে পত্রিকা ভেদে কি নির্দিষ্ট
সময়ে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় ? এর পিছনে যে এক বিরাট মুনাফালোভী কিছু মানুষের
বিজ্ঞানকে ব্যাবহার করে ও মানুষের অন্ধতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে তা আজকের
একবিংশ শতাব্দীতেও সুসপষ্ট।
তথ্যসূত্রঃ
১.http://www.astrology-zodiac-signs.com/
২.বিজ্ঞানের ইতিহাস-সমরেন্দ্রনাথ সেন
৩.ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট- http://www.nsf.gov/statistics/seind14/content/chapter-7/c07.pdf
0 Comments