প্যান্ডেমিকের সাতকাহন- পর্ব ১

লিখেছেন পৃথ্বী রাজ দাশ




চিত্রঃ মধ্যযুগে ব্ল্যাক ডেথ নিয়ে আঁকা ছবি

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৩৷ ড. লিউ জিয়ান লুন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন হংকং এ৷ তিনি গুয়াংডং এর সান ইয়াৎ সেন হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার৷ বিয়ের জন্য উপহার কিনেছেন তার শহর গুয়াংডং থেকেই৷ বিয়ের উপহারের সাথে তিনি আর একটি মারাত্মক জিনিস তার সাথে নিয়ে যাচ্ছেন, যা সারা বিশ্বে ভয় ছড়িয়ে দেবে আর কয়েকশ প্রাণ কেড়ে নেবে ৷ হংকং এ পৌঁছে তিনি কাওলুন এর মেট্রোপলিটন হোটেলের নবম তলায় একটি রুম ভাড়া নেন৷ আসার পথে তার শুকনো কাশি ছিল এখন সাথে জ্বর ও বুক ব্যাথা আছে তার৷ লিফটে উঠে নবম তলার বাটন চাপ দেন তিনি৷ তার সাথে লিফটে ছিল চাইনিজ-আমেরিকান ব্যবসায়ি জনি চেন৷ তিনিও নবম তলায় একটি রুমে আছেন ৷ করিডরে ড. লিউ কানাডা প্রবাসী মিসেস কোয়ান সুই চুউ কে পাশ কাটিয়ে যান৷ মিসেস চুউ ঐ লিফটে নিচে নামেন ৷ আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা তিনজনই মারা যাবেন এক নতুন ধরণের রোগে যা পৃথিবী আগে দেখি নি, নেই কোন প্রতিষেধক এবং শুরু করবে এক আন্তর্জাতিক সংকট এর৷

আমরা কথা বলছি ২০০৩ সালের SARS pandemic নিয়ে৷

চিত্রঃ সার্স করোনা ভাইরাসের কাল্পনিক চিত্র  
 ২০০২ এর নভেম্বর মাস হতেই দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং এ একটি নতুন ধরণের ভাইরাসঘটিত ফ্লু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়৷ প্রথমে ৫ জন ভর্তি হন যারা সকলে গবাদিপশু বিশেষত হাঁস মুরগী পালন করতো৷ ড. লিউ নিজেই শনাক্ত করেন যে এ নতুন ফ্লু এর এন্টিবডি নতুন আক্রান্ত রোগীর দেহে তৈরি হয় না৷ তারমানে এটি একদম নতুন একটি ভাইরাস৷ তিনি আরো জানতেন খুব দ্রুত এটি ছড়িয়ে যাচ্ছে৷ কারণ একই উপসর্গ নিয়ে আরো রোগী ভর্তি হচ্ছেন প্রতিদিন৷ উপসর্গ গুলো হল প্রথমে সর্দি, এর শুকনো কাশি, জ্বর,গলা ব্যথা ৷ পরবর্তীতে শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়া৷ ড. লিউ বুঝতে পারেন নি যে তিনি নিজেও এতে আক্রান্ত হয়েছে৷ নিজের অজান্তে দক্ষিণ চীনের এক শহর থেকে এ রোগ তিনি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন৷

চীন সরকার জানতো, নতুন এক রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছে৷ কিন্তু তাকে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা হিসেবে গণ্য করে WHO কে অবহিত করে নি৷ তবে WHO গোপন সূত্রে খবর পাচ্ছিলো নতুন কোন রোগ এসেছে দক্ষিণ চীনে৷ ২৩ ফেব্রুয়ারী চাইনিজ-আমেরিকান ব্যবসায়ি জনি চেন যান ভিয়েতনামে ব্যবসার কাজে৷ কিন্তু হ্যানয় শহরে নেমেই তিনি জ্বর আর বুকে ব্যথা অনুভব করেন৷ তিনি ভর্তি হন হ্যানয়-ফ্রেঞ্চ হাসপাতালে৷ সেখানে তাকে চিকিৎসা দেন ইতালিয় ড. কার্লো ওবাণী৷ তিনি কিছু একটা অস্বাভাবিকতা অনুমান করেন৷ ভেবেছিলেন এটি কোন খারাপ ধরণের ফ্লু হবে৷ তিনি প্রথম SARS এর লক্ষণ নথিভুক্ত করেন এবং সেই সাথে WHO কে অবহিত করেন৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে ড.কার্লো নিজেও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান৷

কানাডা প্রবাসী মিসেস চুউ মেট্রোপলিটন হোটেল ছেড়ে কনাডার বিমান ধরেন৷ টরেন্টো বিমানবন্দরে তার ছেলে তাকে নিতে আসে৷ অনেকদিন পর মা কে দেখে জড়িয়ে ধরে সে৷ কিন্তু দুসপ্তাহের মধ্যে তারা দুজনই SARS রোগে মারা যান৷ এভাবে এরোগ উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত পৌছে যায়৷ WHO এর প্রবল চাপে, অবশেষে চীন সরকার নতুন রোগ সম্পর্কে স্বীকার করে এবং সকল প্রকার সহযোগীতার আশ্বাস দেয়৷ পৃথিবীর সকল বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞরা এটির প্রতিরোধ ও প্রতিকারের পথ খুঁজতে থাকে৷

এ রোগ সৃষ্টি করে এক প্রকার করোনা ভাইরাস৷ এর নামকরণ করা হয় Sars-Cov ৷ মানবদেহে এর incubation period ৪ থেকে ৬ দিন৷ তবে ১ থেকে ১৪ দিনও হতে পারে৷ এটি ছড়ায় হাঁচি কাশির মাধ্যমে৷ আক্রান্ত ব্যক্তির respiratory droplet এর সংস্পর্শে আসলে৷ এটি প্রধানত ফুসফুসকে আক্রমণ করে৷ একপ্রকার ধ্বংসই করে দেয়৷ রোগী ভয়াবহ নিউমোনিয়ার শিকার হয়৷ শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত উদ্দিপ্ত হয়ে cytokine storm ঘটায়৷ ফুসফুসে জল জমতে থামে৷ আর রোগী এর ফলে মারা যায়৷ এর কোন নির্দিষ্ট ঔষুধ নেই৷ এন্টিপাইরেটিকস ঔষুধ(জ্বর কমানের ঔষুধ), কৃত্রিম ভেন্টিলেশন এবং সেকেন্ডারি ইনফেকশন না হওয়ার জন্য কিছু এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়৷ রোগীকে আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিনে রাখা, এ রোগের বিস্তার রোধে সবচেয়ে কার্যকর৷ তাছাড়া হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার এবং social distancing ও এ রোগের ঝুকি কমায়৷ এ প্যানডেমিক শেষে প্রায় ৭৭৪ জন মারা যান৷

বিজ্ঞানিরা খোঁজ করতে থাকেন কোত্থেকে এই ভাইরাসের উদ্ভব৷ প্রথমে তারা ভেবেছিল হাঁস-মুরগী-শুকর হতে এটি spill over হয়ে মানুষে এসছে৷ কিন্তু এ ভাইরাসের ডিএনএ বিশ্লেষণ বলছে সিভেট ক্যাট হতে এটি মানুষে এসছে৷ ২০১৭ সালে ইউনান এর একটি গুহার হর্সশু বাঁদুর এও এই ভাইরাস পাওয়া যায়৷ বিজ্ঞানিরা বলছেন বাদুর হতে সিভেট, এর পর তা মানুষে এসছে৷ কিন্তু হর্সশু বাঁদুর বা সিভেট ক্যাট তো থাকে গহীন বনে বা গুহার ভেতরে৷ তা মানুষে আসলো কি করে!! চীনে রয়েছে অবৈধ বন্যপ্রাণীর ব্যবসা৷ গুয়াংডং এর কাঁচা বাজারেও সিভেট-বাঁদুর সহ নানা বন্যপ্রাণী কেনাবেচা হয়৷ রাখা হয় খুব কাছাকাছি খাঁচাতে৷ ফলে ভাইরাসের Inter-species spillover খুব সোজা হয়ে যায়৷ ২০১৭ সালে বিজ্ঞানীরা বলেন, এসব বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা বন্ধ না হলে SARS এর মত মহামারী কেবল সময়ের ব্যাপার৷ আর তারা কতটা নিঁখুত ভবিষ্যতবাণী করেছে তা ২০২০ এ আমরা ভালই বুঝতে পারছি৷
চলবে.....

Post a Comment

0 Comments