মারি কুরির নিরলস সংকল্প এবং অপরিসীম কৌতূহল তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে একজন আইকন হিসাবে পরিণত করেছিল।শারিরীক ভাবে অত্যন্ত ক্লান্তিকর হওয়া সত্ত্বেও অমানুষিক পরিশ্রম ও প্রজ্ঞার মধ্যে দিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম। যা ব্যবহৃত হয়েছে ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায়। তেজস্ক্রিয়তা কে মৌলিকভাবে বোঝার জন্যে মেরি কুরির আবিস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মেরি কুরি 1867 সালে রাশিয়ার জার শাসিত পোল্যান্ডের ওয়ার্সায় জন্ম নেন। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল মারিয়া শক্লোদভস্কা। মেরির পরিবারকে নিষ্ঠুর জারের শাসনামলে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। জারের শাসনামলে পোলিশ রীতি, সংস্কৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
মেরি কুরি |
মেরি কুরি তার বাবা ও দুই বোনের সাথে ( বাম পাশ থেকে) |
কুরির বাবা-মা ছিলেন পোলিশ, এবং তারা উভয়েই শিক্ষক ছিলো; তাদের কর্মসংস্থান ছিলো অনিশ্চিত । কুরির বাবা চাকরী থেকে চাকরিতে ছুটে বেরিয়েছেন এবং পরিবারটিও ক্রমাগত ছোট থেকে ছোট বাসায় স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল। মেরির বয়স যখন ১১ বছর তখন মেরির মা যক্ষ্মায় মারা গিয়েছিলেন আর তাঁর বড় বোন মারা যান টাইফয়েডে।
মেরি কুরির মাধ্যমিক স্কুল ডিপ্লোমা সার্টিফিকে, ১৮৮৩ |
কৈশোর বয়সে কুরি তার বোন ব্রোনিয়ার সাথে একটি চুক্তি করেছিলেন। চুক্তিটি বড়ো বোন যতদিন প্যারিসের মেডিকেল স্কুলে পড়বে ততদিন মেরি টিউশনি ও গভর্নেসের কাজ করে বড়ো বোনকে সহায়তা করবেন, আর বড়ো বোনের পড়াশোনা শেষ হলে বড়ো বোন মেরিকে সয়াহতা করবে। ১৭ বছর বয়স থেকে, ছয় বছর ধরে, মেরি কুরি টিউশনি ও গভর্নেসের কাজ করেছেন বড়ো বোনকে সহায়তা করার জন্যে।
অবশেষে, 24 বছর বয়সে, তিনি ফ্রান্সের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি তার ভাইয়ের মতো ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে পারেননি কারণ জারশাসিত রাশিয়ান সাম্রাজ্যে নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা নিষিদ্ধ ছিল। প্যারিসে, তিনি অপ্রস্তুত ছিলেন তবে আনন্দিত বোধ করেছিলেন।
মেরি কুরি, ক্রোনোমিটার হাতে তেজস্ক্রিয়তা পরিমাপের সময়, ১৯০৪ সালে |
"এটি ছিল আমার সামনে নতুন পৃথিবী উন্মোচিত হওয়ার মতো, বিজ্ঞানের পৃথিবী, যার মধ্যে নিহিত ছিল আমার প্রকৃত মুক্তি"
- মেরি কুরি
মেরি কুরির পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট (পিএইচডি) করার জন্য থিসিস, ১৯০৩ |
মেরি কুরি তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে থিসিস করার স্বীদ্ধান্ত নেন। হেনরি বেকেরেল সম্প্রতি ইউরিনিয়ামের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়তা আবিস্কার করেছেন। মেরি কুরি পরীক্ষা করে দেখেন যে ইউরিনিয়াম সমৃদ্ধ একটি আকরিকের তেজস্ক্রিয়তা কেবল ইউরিনিয়াম থাকলে যা হতো তার থেকে অনেক বেশি। এই আবিস্কার মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরিকে গবেষণায় উদ্ভুদ্ধ করে। যার মধ্য দিয়ে তাঁরা ইউরিনিয়াম অপেক্ষা ৪০০ গুন বেশি তেজস্ক্রিয় পরমানু 'পলোনিয়াম' আবিস্কার করেন। ১৮৯৮ সালে পলোনিয়াম পর্যায় সারণিতে যুক্ত হয়। পলোনিয়াম নামটা মেরি কুরি দিয়েছিলেন তাঁর পরাধীন দেশ পোল্যান্ড এর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সম্মান জানিয়ে।
ইউরেনিয়ামের প্রাথমিক খনিজ আকরিকগুলির মধ্যে একটি, যেখান থেকে মেরি কুরি পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন |
তারপর মেরি কুরি পলোনিয়াম অপেক্ষা অধিক তেজস্ক্রিয় পরমানু আবিস্কার করেন। যার নাম দেন 'রেডিয়াম'। এটা ছিল একটা মৌলিক আবিস্কা। এর মাধ্যমে জানা যায় তেজস্ক্রিয়তা আনবিক পর্যায়ের বিষয় ছিল না, বরং ছিল পরমানুর ভেতরকার বিষয়। তার মধ্য দিয়ে এতকাল পরমানুকে যেভাবে জড়, অবিভাজ্য, কঠিন উপাদান ভাবা হতো তার অবসান হয়।
তেজস্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা দেওয়ার ফলে মেরি কুরি বেশ জনপ্রিয় হয়ে যান। যার ফলাফল ১৯০৩ সালে তিনি প্রথম নোবেল বিজয়ী নারী বিজ্ঞানী হোন।প্রথম দিকে ফ্রেঞ্চ একাডেমিয়া নোবেলের জন্য মেরিকে মনোনয়ন দিতে চায় নি, তখন পিয়েরে কুরি ফ্রেঞ্চ একাডেমিয়া কে বোঝাতে সমর্থ হোন এই আবিস্কার মেরি-পিয়েরের যৌথ আবিস্কার।
সহ-বিজয়ী হেনরি বেকারেল এর সাথে মেরি এবং পিয়েরে কুরি,১৮৯৮ |
১৯১১ সালে, তিনি রেডিয়াম সংশ্লেষনের পদ্ধতি আবিস্কারের জন্যে রসায়নের ক্ষেত্রে আরও একটি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। মেরি কুরি এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানের দুইটি শাখায় নোবেল পাওয়া একমাত্র বিজ্ঞানী। সেই সময় থেকেই কুরি বিশ্বখ্যাত, এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে কিউরি ইনস্টিটিউট) কুরি ল্যাবরেটরির পরিচালক।
পিয়েরে কুরি ছিলেন মেরি কুরির জীবনের প্রেম এবং তার বিজ্ঞানের অংশীদার। তাদের 1894 সালে দেখা
পিয়েরে কুরি ছিলেন মেরি কুরির জীবনের প্রেম এবং তার বিজ্ঞানের অংশীদার। তাদের 1894 সালে দেখা
রেডিয়াম ইনস্টিটিউট, প্যারিসে কুরি প্যাভিলিয়ন 1925 |
হয়েছিল যখন মেরি কুরি পিয়ের কুরির ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছিলেন; পরের বছর তাদের বিয়ে হয়েছিল।
"[পিয়েরে] তার জীবনটি তার বিজ্ঞানের স্বপ্নে উৎসর্গ করেছিলেন: তিনি এমন এক সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন যিনি তাঁর সাথে তাঁর স্বপ্নটি বাচিঁয়ে রাখতে পারেন।"
-মেরি কুরি
এই দম্পতির দুটি কন্যা ছিলো আইরিন এবং ইভ, এবং তাদের বিয়ের কয়েক বছর পরে পিয়েরি কুরি তার স্ত্রীর তেজস্ক্রিয়তার স্টাডিতে যোগ দিতে নিজের গবেষণা ত্যাগ করেছিলেন।
মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি তাদের বাড়ির সামনে, ১৮৯৫ সাল |
ইভের জন্মের কিছুদিন পরেই পিয়েরে- মেরির ট্র্যাজিক বিচ্ছেদ হয়।
১৯০৬ সালে পিয়েরে কুরি একটি ঘোড়ায় টানা মালগাড়ির নিচে পড়ে যান এবং মারা যান।
মেরি কুরি বিশ্বাস করতেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা সকল মানুষের মঙ্গলের জন্য করা উচিত। তিনি এবং তার স্বামী আবিষ্কার করেছিলেন যে রেডিয়াম সুস্থ কোষের চেয়ে রোগাক্রান্ত কোষগুলিকে দ্রুত ধ্বংস করেছে এবং এভাবে রেডিয়েশনটি টিউমার, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
১৯০৬ সালে পিয়েরে কুরি একটি ঘোড়ায় টানা মালগাড়ির নিচে পড়ে যান এবং মারা যান।
মেরি কুরি বিশ্বাস করতেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা সকল মানুষের মঙ্গলের জন্য করা উচিত। তিনি এবং তার স্বামী আবিষ্কার করেছিলেন যে রেডিয়াম সুস্থ কোষের চেয়ে রোগাক্রান্ত কোষগুলিকে দ্রুত ধ্বংস করেছে এবং এভাবে রেডিয়েশনটি টিউমার, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্যে মেরি কুরি এক্স-রে ব্যবহারের প্রচলন করেছিলেন। তিনি এক্সরে বহনকারী গাড়ির ব্যবস্থাকরেছিলেন যা পরবর্তীকালে "কুরি ভ্যান" নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
মেরি কুরি এবং তার মেয়েরা,
আইরিন ও ইভ, ১৯০৮ সাল
|
কুরি দম্পতি তারা যে তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলি পরিচালনা করছিলো তার বিপদ গুলোর মর্ম উপলব্ধি করেছিলো না।
পিয়েরে কুরি তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেন হাতে তেজস্ক্রিয়তা জনিত ক্ষত তৈরি হয়েছে । তা সত্ত্বেও ভেজা, স্যাঁতসেঁতে ঘরে দিনের পর দিন টনের পর টন পিচব্লেন্ড আকরিক হতে রেডিয়াম সংশ্লেষ
করেছেন।
মেরি কুরি একদল নার্স দের চিকিৎসার
ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার সম্ভাব্য
উপকারিতা ব্যাখা করছেন, ১৯১৬ সাল।
|
"আমাকে শিখানো হয়েছিল যে অগ্রগতির পথটি কখনো মোলায়েম বা সহজ ছিল না।"
ম্যারি কুরি।
তাদের দুজনই ক্রমাগত বিকিরণের ফলে অসুস্থতা তৈরি হয়েছিল। মেরি কুরি 1935 সালে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ায় মাত্র 66 বছর বয়সে মৃত্যু ছিলো সম্ভাবত তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শের কারণে। তার কয়েকটি বই এবং কাগজপত্র এখনও তেজস্ক্রিয়তার কারণে সীসার বক্সে সংরক্ষণ করা হয়। এটা স্বাভাবিক যে মেরি কুরি এমন একটি বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকার রেখে গেছেন যা স্পর্শ করা দুরুহ ।
Photo:মেরি কুরি সেই গাড়িটা চাল্লাচ্ছেন যেটা তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিওলজিকাল ইউনিটে রূপান্তরিত করেছেন। |
Photo: ফ্রান্সের রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে তার রসায়ন পরীক্ষাগারে মেরি কুরি @ দ্য নেদারল্যান্ডস ন্যাশনাল আর্কাইফ |
Photo:মেরি কুরির একটা অন্যতম মোবাইল এক্স রে ইউনিট যা ফরাসি আর্মিরা ব্যবহার করেছিলো |
Photo: সেই রুম যেখানে ইউরেনিয়াম আকরিক নিয়ে পরীক্ষা চলছিলো। |
Photo: সেই রুম যেখানে ইউরেনিয়াম আকরিক নিয়ে পরীক্ষা চলছিলো। |
photo: রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স কে মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরির ধন্যবাদ চিঠি, (পৃষ্টা ১), ৯ নভেম্বর ১৯০৩। |
মূল লেখার লিংকঃ
https://www.nobelprize.org/womenwhochangedscience/stories/marie-curie
0 Comments