ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির বিজ্ঞান কনফারেন্স কেমন দেখলাম

লিখেছেন

 জুনায়েদ হাসান


বিজ্ঞান কনফারেন্সে লেখক


“ আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।“
                                       -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের পর যে বিপুলা পৃথিবী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামনে উপস্থিত হয়েছিল, পৃথিবীর অত্যাশ্চার্য সৌন্দর্য, অসীম কালের সমুদ্র হিল্লোল কবির কবিসত্ত্বাকে জাগ্রত করেছিল। কবিকে দিয়ে তৈরি করে নিয়েছিল অসামান্য সব সাহিত্যকর্ম। নতুনকে জানার আকাঙ্খা, অপরিচিতকে চেনার আকাঙ্খা কবিকে এক জায়গার স্থির থাকতে দেয় নি।

যখন ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞান সংগঠন ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির “Integrating Science with Society” শীর্ষক কনফারেন্সে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম স্বভাবতই আনন্দিত হলাম। ২০১২ সাল থেকেই ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির বাংলা প্রকাশনা 'প্রকৃতি' ও ইংরেজি প্রকাশনা 'Break through' বিশেষ করে তাদের প্রকাশিত বিবর্তনবাদের উপর লেখা বই “ বিবর্তন যুগে যুগে” ও “ A brief history of science” আমার চিন্তা জগতকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিল। সেজন্য ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির এই কনফারেন্স নিয়ে আগে থেকেই উচ্ছাসিত ছিলাম। কিন্তু সেখানে কনফারেন্সে যোগ দিয়ে যা কিছু শিখেছি, যা কিছু জেনেছি তা আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি ছিল। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইদিন ব্যাপি সায়েন্স কনফারেন্সের অভিজ্ঞতা বলার পূর্বে যাদের আর্থিক সহযোগিতা তথা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, আমার বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাদের এই সহযোগিতা না পেলে আমার পক্ষে এই বিজ্ঞান কনফারেন্সে যোগ দেওয়া সম্ভব হতো না।
                                                        
বিজ্ঞান কনফারেন্সের অভিজ্ঞতা বর্ণনার পূর্বে ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির সম্পর্কে কিছু বলা দরকার।
Science for Society, Science for Man, Science in Thinking অর্থাৎ সমাজের জন্য বিজ্ঞান, মানুষের জন্য বিজ্ঞান, চিন্তার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এই স্লোগানকে সামনে রেখে ১৯৯৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এই সংগঠন যাত্রা শুরু করে। ২০১৪ সালে অল ইন্ডিয়া বিজ্ঞান কনফারেন্স এর মাধ্যমে সারা ভারতে এর সাংগঠনিক কার্যক্রমকে বিস্তৃত করে। ভারতের স্বনামধন্য বিজ্ঞানী সহ বিজ্ঞানমনষ্ক সাধারণ মানুষদের নিয়ে ভারতে এই সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে।

ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির ম্যানিফেস্টোতে দ্ব্যার্থহীনভাবে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। আমি শুধুমাত্র প্রথমটা উল্লেখ করছি।

“ To cultivate and promote scientific outlook and logical faculty of mind to establish a scientific culture in the society”.

সমাজের কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক ধারণা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা সহ সকল প্রকার গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটি সঠিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিশীল চিন্তাপদ্ধতি গড়ে তোলা এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

কনফারেন্স যে বিষয়ের উপর হয়েছে সেটার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই এই সংগঠনের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা চোখে পড়ে। এই কনফারেন্সের শিরোনাম ছিল, “Integrating Science with Society” অর্থাৎ সমাজের সাথে বিজ্ঞানকে একীভূতকরণ।

শিরোনাম দেখে আমার প্রথমে মনে হয়েছিল যে প্রধানত Breakthrough Science Society’র এক্টিভিস্টরাই এই কনফারেন্সে অংশগ্রহন করবে। আমি বিস্মিত হই  ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, ডাক্তাররা এই কনফারেন্সে অংশগ্রহন করেছে। বিশ্ববিশ্রুত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর জয়ন্ত ভি নারলিকার পদ্মবিভূষণ ও অংশগ্রহণ করেছিলেন এই কনফারেন্সে। আরো একটি ব্যাপার দেখে অবাক হই যে ভবনে ” অর্থাৎ গান্ধী ভবনে এই কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয়  তার ধারণক্ষমতা ছিল ৫০০ জন। ফি ধার্য ছিল ১০০০ রুপি ও ২০০০ রুপি। আয়োজক আসন স্বল্পতার জন্য আগেই রেজিস্ট্রেশন করার আহবান করেছিল। দেখলাম আসন পূর্ণ হয়ে যাওয়াতে অনেকজন যারা আগ্রহী ছিল তারা রেজিস্ট্রেশন করতে পারে নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমনটা আসলে ভাবা কঠিন। এরকম সমাজঘনিষ্ঠ বিজ্ঞান কনফারেন্সে আসন সংখ্যার অতিরিক্ত অংশগ্রহনকারী থাকবে।
কনফারেন্স শুরু হয় ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮। উধ্বোধন ঘোষণা করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর সুরঞ্জন দাস। উনার বক্তব্যের শুরুতেই উনি আক্ষেপ করে বলেছেন যে ইতিহাসের অধ্যাপক হয়েও তিনি বিজ্ঞান কনফারেন্স উধ্বোধন করছেন।

“ বিজ্ঞানের দর্শন”
শিরোনাম দেখে একটু খটকা লাগতে পারে। বিজ্ঞান একটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি যা পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয় আবার দর্শন ও একটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি যা বিজ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার আগে পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য ব্যবহৃত হত। সেক্ষেত্রে শিরোনামে দুটি বিষয়কে একসাথে লেখাটা পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগাতে পারে। বিজ্ঞানের কি আসলে কোন দর্শন আছে? নাকি বিজ্ঞান কেবলই একটা পদ্ধতি?

এমনকি আইজ্যাক নিউটনের সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা নিজেদের দার্শনিক বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। নিউটনের সুবিখ্যাত বইয়ের নামের সাথেও জড়িয়ে আছে দর্শনের নাম, “Philosophia Naturalis Princioia Mathmatica”.


বিজ্ঞানের দর্শনঃ

কনফারেন্সের প্রথম সেশন ছিল বিজ্ঞানের দর্শন বিষয়ক। প্রথম সেশনে বক্তব্য রাখেন প্রফেসরS.G Dani , প্রফেসরG Nagarjune এবং বাংলাদেশ থেকে আগত প্রফেসর Liaquat Ali.

শুরুতেইS.G Dani বিজ্ঞানের দর্শন বিষয়ক আলোচনা রাখেন। তিনি বলেন, দর্শন একটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, বিজ্ঞান ও একটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি। বিজ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার আগে দর্শনই পৃথিবীর কিংবা মহাবিশ্বের সমস্ত ঘটনা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করত। বর্তমানে সত্যানুসন্ধ্যানের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার বিজ্ঞান। পূর্বে শতধা বিভক্ত দর্শন খন্ডিতভাবে সত্যানুসন্ধ্যানে চেষ্টা করত। কিন্তু বিজ্ঞান সত্যানুসন্ধ্যানের একটি সর্বাত্মক ও সমন্বিত প্রয়াস।

মেঘনাদ সাহার মতে “ বিজ্ঞান কখন ও চিরন্তন সত্য আবিষ্কার করিয়াছে বলিয়া দাবী করে না, কিন্তু সাধকের অনুসন্ধিৎসা বৃত্তিকে সজাগ রাখিয়া তথ্য সন্ধানের পন্থা বলিয়া দেয়”। 

বিজ্ঞান আজকের অবস্থানে আসার পরিক্রমায় দর্শনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল। সেটা থেলিস বা নাম না জানা পূর্বের বিজ্ঞানী থেকে আজকের বিজ্ঞান এক অবিচ্ছিন্ন ধারা। বহুমতের সংশোধন, উন্নয়ন, পরিমার্জন করেই বিজ্ঞান এগিয়ে চলছে এবং সামনেও এগিয়ে যাবে। সেজন্য দেখা যায় “Positivism বা প্রত্যক্ষবাদ” প্রভাবিত বিজ্ঞান একসময় কুসংস্কার বা বিভিন্ন ভাববাদী প্রবণতার সাথে লড়াই করেছে আবার একসময় এর ভিকটিমে পরিণত হচ্ছে বোল্টজম্যান বা আইনস্টাইনের মত প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা। যে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম জনক  সেই আইনস্টাইন "Positivism" ( অর্থাৎ,  যা খালি চোখে দেখা যায় না বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না তা বিশ্বাস করা যাবে না) এর খপ্পরে পড়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিরোধিতা করে বলে বসলেন GOD Does not  play Dice অর্থাৎ ঈশ্বর পাশা খেলেন না।

S.G Dani   খুবই গুরুত্বারোপ করেন প্রশ্ন করাকে। বিজ্ঞানে প্রশ্নের গুরুত্ব বোঝাতে তিনি ইবনে আল হাজেনের দারুন একটি উক্তি ব্যবহার করেন।

“ The duty of the man who investigates the writings of scientists, if learning the truth is his goal, is to make himself an enemy of all he reach, and … attack it from every side. He should also suspect himself as he performs his critical examination oh it, so that he may avoid falling into either prejudice or leniency”.

মতে পৌছানোর জন্য যথার্থ প্রশ্ন করার এবং প্রশ্নের উত্তরের যথার্থভাবে বিচার করার ক্ষমতা থাকতে হবে নতুবা মতে পৌছানো সম্ভব।
S.G Dani  আরো একটি  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সেটা হলো 'ফলসিফায়াবিলিটি(মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়ার ক্ষমতা)। কোন একটি বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস (অনুকল্প) কে আমরা বৈজ্ঞানিক থিওরি হিসেবে গ্রহণ করব কিনা তার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে হাইপোথিসিসটি  পরীক্ষণযোগ্য কিনা।
ফলসিফায়াবিলিটি বা বাতিলযোগ্যতা বিজ্ঞানের দার্শনিক কার্ল পপার প্রস্তাব করেছেন। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ একটি গুন হচ্ছে ফলসিফায়াবিলিটি। কার্ল পপার তার  ‘ দ্যা লজিক অব সায়েন্টিফিক ডিস্কভারি’ তে পরিষ্কারভাবে বলেছে A theory of scientific to a degree to which it is testable”.

যেমন, যদি বলা হয় “ মহানবী স্বশরীরে শবে মেরাজের রাতে সাত আকাশ পাড়ি দিয়ে বেহেশতে গিয়েছিলেন” এটি
এমন একটি বক্তব্য যেটা পরীক্ষা করে আমরা সত্য মিথ্যা যাচাই করতে পারব না। কাজেই এটি একটি টটোলজিকাল স্টেটমেন্ট-ফলসিফাইয়েবল নয়। কিন্তু যদি বলা হয় প্রোটন ইলেকট্রনের চেয়ে ভারি সেটা হবে ফলসিফায়াবল স্টেটমেন্ট। কারণ পরীক্ষা করে এর সত্যমিথ্যা যাচাই করা যায়।


বেঙ্গল রেঁনেসা

ভারতবর্ষে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার ইতিহাস কি সে প্রসঙ্গে অত্যন্ত চমৎকার আলোচনা করেন বাংলাদেশ থেকে আগত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্স এর সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর লিয়াকত আলী।

একটা সময় ছিল যখন বলা হতো “ What Bengal thinks today, India thinks tomorrow” 


মূলত বেঙ্গল  রেঁনেসার জন্যই কথাটা বলা হত। বেঙ্গল রেঁনেসার জন্যই কথাটা বলা হতো বলা হতো। বেঙ্গল রেঁনেসাই এই ভারতীয় এই ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার জন্মদাতা। বেঙ্গল রেঁনেসা যাত্রা শুরু করে রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট, পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  এর হাত ধরে। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে প্রত্যাশা করেছিলাম বেঙ্গল রেঁনেসায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের  ভূমিকার ডিটেইলস একটা আলোচনা  তিনি করবেন। কিন্তু,  তিনি ঈশ্বরচন্দ্রের ভূমিকা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে মিলিয়ে বলেন তাদের জ্ঞানগত অবস্থান ছিল পূর্ব ও পশ্চিমের যুক্তিবাদী ধারণা গুলো বিশেষ করে কান্টের দর্শন, উপনিষদীয় দর্শন। তিনি আক্ষেপ করেছেন বেঙ্গল রেঁনেসায়  পরীক্ষাবাদী আলোকজান্ত্রীয় বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি দেখে। সেজন্য তিনি বেঙ্গল রেঁনেসাকে অসমাপ্ত রেঁনেসা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

বেঙ্গল রেঁনেসা অনুপ্রেরণা পেয়েছিল প্রাচীন ভারতের উপনিষদ, ইউরোপীয় রেঁনেসা (প্রধানত যুক্তিবাদী ধারা), হেলেনিস্টিক সভ্যতা (সক্রেটিস, প্লেটো,অ্যারিস্টটল) থেকে। সেজন্য বেঙ্গল রেঁনেসায় ছিল ইউরোপিয়ান রেঁনেসার মত মানবতাবাদ, ছিল যুক্তিবাদ (কিন্তু বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ ভিত্তিক নয়)।
যারা বেঙ্গল রেঁনেসার জন্ম দিয়েছিলেন তারা ইউরোপের পরীক্ষাবাদী ধারা তথা আলেকজান্ত্রিয়ান স্কুল অব থটকে ততটা গুরুত্ব দেয় নি। অথচ আলেকযান্ত্রীয় বিজ্ঞানের পুনর্জন্মের মধ্য দিয়েই ইউরোপে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি সাধিত হয়েছে যেটা বেঙ্গল রেঁনেসায় দারুনভাবে অবহেলিত হয়েছে। বেঙ্গল রেঁনেসা অন্ধতা, গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুক্তিবাদী মানবতাবাদী মনন কাঠামো গড়ে তোলার সংগ্রাম  কেবল মাত্র এই বাংলায়ই করেছে তা নয় বরং সেটা সমগ্র ভারতবর্ষে বিস্তৃত করতে পেরেছিল।

 দ্বিতীয় সেশনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল কিভাবে  বিজ্ঞানমনষ্ক মননকাঠামো গড়ে তোলা যায়। অনেকের ধারণা, যারা বিজ্ঞানে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেছে তারা সাধারণ মানুষের থেকে বেশি বিজ্ঞানমনষ্ক। কিন্তু ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে এর পক্ষে জোরালো প্রমাণ নেই যে বিজ্ঞান নিয়ে পড়লেই বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়া যায়। হয়ত সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদি সময়ে তারা পূজা অর্চনা করছেন না কিন্তু হাত দেখা, জ্যোতিষশাস্ত্র, রাশিচক্র, আত্মায় বিশ্বাস, জিন ভূতে বিশ্বাস কিংবা প্রাত্যাহিক জীবনের সবকিছু ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয় এইসব ধ্যানধারনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শিক্ষায় তথাকথিত শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে তাৎপর্যগত পার্থক্য নেই। এমন অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারণায় বিশ্বাস রাখেন। কিন্তু কেন এমন হয়? এর উত্তর লুকিয়ে আছে সমাজকাঠামোর জটিল বিন্যাসে। এই
অবৈজ্ঞানিক মননকাঠামো সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে আছে। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার বদৌলতে প্রত্যেক মানুষ শৈশব থেকেই এর শিকার হয়। শৈশবে বিজ্ঞানসম্মত পড়াশোনার সাথে ধর্মীয় পড়াশোনাও করা হয়। বিজ্ঞান বই শিক্ষা দেয় একরকম অন্যদিকে ধর্মীয় বই সমূহ শিক্ষা দেয় আরেক রকম। সামন্তীয় পরিবারসমূহে ধর্মীয় বিষয়সমূহে সংশয়পূর্ণ কোন প্রশ্নকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। এভাবে শৈশব থেকেই প্রশ্নহীন কেবলমাত্র নম্বর অর্জনকারী মানুষ গড়ে তোলার আয়োজন চলতে থাকে। সেজন্য দেখা যায় সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এমনকি বিজ্ঞানী হয়েও এই ধরনের ভ্রান্ত চিন্তার অধিকারী তারা হয়ে পড়ে। সেজন্য সর্বস্তরে ধর্মনিরেপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক, গণতান্ত্রিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের পক্ষে প্রচার ও আন্দোলন করার কোন বিকল্প নাই।

তৃতীয় সেশনঃ বিজ্ঞানের নৈতিকতা

বিজ্ঞানের নৈতিকতার দৃষ্টান্ত যুগে যুগে বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা রেখে গেছেন। সার্ভেটাস,ব্রুনোরা বিজ্ঞানের সত্য প্রচার করতে গিয়ে পুড়িয়ে হত্যার স্বীকার হইয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের জনকন হয়েও গ্যালিলিওকে বরন করতে হয়েছিল আমরণ কারাবরণ। লুইস পাস্তুর, মাদাম কুরী সারাজীবনের সংগ্রামের ফসল যখন প্যাটেন্ট করার প্রশ্ন আসলো, সেই সাথে আসলো তাআদের জীবিনে অর্থনৈতিক সুবিধার হাতছানি। তাঁরা সেটি প্রত্যাখান আক্করে স্থাপন করলেন বিজ্ঞানের অজেয় নৈতিকতাকে । মাদাম কুরি প্যাটেন্ট প্রসঙ্গে বলেছিলেন “রেডিয়াম সময়াজের সম্পত্তি। রেডিয়ামের প্যাটেন্ট নেয়া বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির বিরোধী হবে”। বিজ্ঞানের নৈতিকতার সবচেয়ে সুন্দর  কথাটি বলেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বলেছেন “ দিনের মধ্যে শতবার নিজেকে একথা স্মরণ করিয়ে দেই যে, আমার ভিতরের ও বাইরের জীবন অন্য মানুষের শ্রমের উপর নির্ভরশীল। যে পরিমাণে আমি তাদের কাছ থেকে নিয়েছি এবং এখনো নিচ্ছি ঠিক একই পরিমাণে পরিশোধের জন্য আমাকে সচেষ্ট হতে হবে। আমরা যে খাদ্য খাই তা অন্য মানুষেরা উৎপাদন করে, যে কাপড় পরি তা অন্যদের তৈরি, যে বাড়িতে বাস করছি তাও অন্যরা নির্মাণ করেছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের একটি বিরাট অংশ আমাদের কাছে এসেছে ভাষার মধ্য দিয়ে, এই ভাষাও অন্যরা সৃষ্টি করে গেছে।

এই সেশনে ডাক্তার C. Prabhakana Reddy ভারতবর্ষের চিকিসা ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে প্রশ্ন রেখেছেন ঠিক কখন
মেডিক্যাল রিসার্চের মান সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌছাকে যেখানে প্রতিনিয়ত মেডিক্যাল ইথিকস দারুনভাবে মার খাচ্ছে।
বিজ্ঞান কনফারেন্সের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বিজ্ঞানীদের অভিনিত নাটক “ Uncertainty of principles” মূলত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবাসীর মননে ধাক্কা দেয়ার জন্য Break throughScience Society এই নাটকের আয়োজন করে। নাটকে বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তার মধ্যে দ্বন্দ সংঘাত দেখানো হয়। নাটকটি দেখে আমার একবারও মনে হয় নি যারা নাটক করছে তাঁরা কেউ প্রফেশনাল অভিনয় শিল্পী নন।
এই ছোট লেখায় সমগ্র বিজ্ঞান কনফারেন্সের বিষয় তুলে আনা এককথায় অসম্ভব ব্যাপার।  

যার কথা না বললে লেখাটা অসম্পূর্ন থেকে যাবে তিনি হলেন বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী  প্রফেসর জয়ন্ত ভি নারলিকার পদ্মবিভুষণ। তিনি ওপেন সেশনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের  ওপেন এয়ার থিয়েটারে বক্তব্য দেন। ওপেন এয়ার থিয়েটারটাও একটা দারুন স্থাপনা। এরূপ স্থাপনা বাংলাদেশের কোথাও আমি দেখিনি। উনি বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগে মানুষ প্রমাণ ছাড়া কেন বিশ্বাস করে, কেন মানুষ পাথরের মূর্তি গনেষ দুধ খায় এরকম কুসংস্কারে বিশ্বাস করে সেসব বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি ক্ষতিকর কুসংস্কারের প্রচার যেমন বিরোধিতা করেন একইসাথে তিনি ক্ষতিকর প্রযুক্তির ও বিরোধিতা করেন। তিনি অকারণে অকারণে ধর্মবিদ্বেষেরও সমালোচনা করেছেন। সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসে অকারণ আক্রমণ না করে কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এটা বোঝাতে সূর্য ও বাতাসের গল্পটার ভিন্ন একটা পাঠ আমাদের সামনে হাজির করেন। সংক্ষেপে গল্পটা ছিল এরূপ, “ একবার বাতাস ও সূর্য কার শক্তি বেশি সেটা পরীক্ষার জন্য এক ব্যক্তিকে চয়ন কড়া হয় এবং বলা হয় বাতাস কিংবা সূর্য যে ঐ ব্যক্তির গা থেকে চাদর অপসারণ করতে সমর্থ হবে সেই বেশি শক্তিশালী। প্রথমে বাতাস প্রবল বেগে ঐ লোকটাকে আক্রমন করলো কিন্তু দেখা গেল বাতাসের বেগ যত বাড়ছে ঐ লোক তত শক্ত করে তার গায়ে চাদর ধরে রাখছে এবং শেষ পর্যন্ত বাতাস ঐ ব্যক্তির গা থেকে চাদর অপসারণে ব্যর্থ হয়। অপরদিকে সূর্য যখন তার কিরণ প্রবলভাবে বে ঐ ব্যাক্তির দিকে নিক্ষেপ করেছে তখন ঐ ব্যাক্তি এমনিতেই তার গায়ের চাদর খুলে ফেলেছে। সেজন্য ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অবৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারনাসম্পন্ন মানুষকে যখন তার চিন্তা পরিবর্তনের জন্য অযৌক্তিক আঘাত কড়া কড়া হয় তখন দেখা যায়  তারা তাদের বিশ্বাসকে আরো প্রবলভাবে আকড়ে ধরছে। সে জায়গা থেকে যারা সমাজে বিজ্ঞান মনষ্কতার বীজ রোপন করতে চায়, তাদের ঐ ধর্মান্ধ মানুষদের সামনে সূর্যের মতো প্রতিভাত হতে হবে যেনো ঐ যুক্তির সামনে মানুষ তার কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারনা ছুড়ে ফেলে।

সবশেষে Break Through Science Society কে অসংখ্য ধন্যবাদ এরকম একটি Science Conference এ বাংলাদেশ থেকে একমাত্র Delegate হিসেবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।






                                                                                     

Post a Comment

0 Comments