কোভিড-১৯, পুঁজিবাদ এবং উদীয়মান রোগসমূহ

অনুবাদ করেছেন আরাফাত সাদ

  পৃথিবীজুড়ে কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঘটেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখের বেশি রোগী পাওয়া গিয়েছে এবং ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে। এই বিস্তার থামানো যেত, যদি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যেমন: গণহারে টেস্টিং করানো হত, যদি গত কয়েক দশকে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ না কমানো হত, বেসরকারিকরণ না করা হত। কিন্তু এই ভাইরাসের
উপত্তিই বা ঘটলো কিভাবে? উৎপত্তিটাও কি থামানো যেত?


কোভিড-১৯ এর বিস্তার এবং বন্যপ্রাণীর বাজার
নেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, প্যাঙ্গোলিনের দেহের পাওয়া ভাইরাসের সাথে কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স প্রায় মিলে যায়। অর্থাৎ মানুষের দেহে এই ভাইরাস প্যাঙ্গোলিন থেকে ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে [1]। প্রাণী দেহ থেকে ছড়ায় বলে একে জুওনটিক ভাইরাস বা রোগ বলা হয়। প্যাঙ্গোলিন হল পৃথিবীর সবচেয়ে পাচার করা প্রাণীগুলোর একটা। ট্র্যাডিশনাল ঔষধ তৈরীতে প্যাঙ্গেলিনের চামড়া ব্যবহার করা হয়। অনেক দেশে প্যাঙ্গোলিনের মাংস এক ধরনের বিলাসী খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নভেল করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য উপত্তিস্থল, উহান বন্যপ্রাণী বাজারেও প্যাঙ্গোলিন বিক্রি করা হত। সেই বাজারে প্রচুর মানুষের সমাগম হত, সম্পূর্ণ বাজার নোংরা অবস্থায় ছিল এবং কোন ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানা হত না। এছাড়া নভেল করোনাভাইরাসের প্রাকৃতিক উৎস হিসেবে বাদুড় চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ এই ভাইরাসটি প্রথমে বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিনে ছড়ায়। তারপর প্যাঙ্গোলিন থেকে মানুষে ছড়ায়। উহান বাজারে বাদুড়ও পাওয়া যেত।
২০০২ সালে সার্স ভাইরাসের সংক্রমণও একইভাবে ঘটেছিল। বিজ্ঞানীদের মতে সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুড় থেকে গন্ধগোকুলে (Civet cats) ছড়ায়, তারপর চীনের গুয়াংডং রাজ্যের বন্যপ্রাণী বাজার থেকে মানুষে ছড়ায়। উল্লেখ্য যে, বন্যপ্রাণীগুলোর প্রধান ক্রেতা চীনের উচ্চবিত্তরা। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞানী ইউয়েন কোক ইয়ুং ২০০৩ সালেই বলেছিলেন
“যদি বন্যপ্রাণী থেকে মানুষে ভাইরাস সংক্রমণ রোধ না করা যায়, তাহলে এইরকম মহামারী আবার হবে– তাই বন্যপ্রাণী পালন, জবাই ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি সঠিক ছিলেন। ২০০৩ সালে ব্যাপকভাবে সার্স ভাইরাসের বিস্তার ঘটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন প্রকার বাধা নিষেধ ছাড়াই বন্য প্রাণীর রমরমা ব্যবসা চলছিল। ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী চীনের বন্যপ্রাণী শিল্প থেকে বছরে প্রায় ৫৭০০ কোটি পাউন্ড মুনাফা পাওয়া যায়। কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঘটার পর গত ফেব্রয়ারি চীনা প্রশাসন খাবারের জন্য বন্যপ্রাণী লেনদেন নিষিদ্ধ করে কিন্তু ঔষধ বা পশমের জন্য এখনো নিষিদ্ধ করা হয় নি।
এটা কোনো “চাইনিজ” ঘটনা নয়
ট্রাম্প প্রশাসনের বর্ণবাদী ভাষ্য অনুযায়ী নভেল করোনা ভাইরাস এক ধরনের “চাইনিজ ভাইরাস”। প্রাণী থেকে মানুষে ভাইরাস ছড়ানোর ঘটনা এর আগেও বহুবার ঘটেছে। শুধু বন্যপ্রাণী না, গৃহপালিত প্রাণী বা খামারের প্রাণী থেকেও ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে যেমন: মুরগী থেকে বার্ড ফ্লু, শুকর থেকে সোয়ািন ফ্লু। এছাড়া শিল্পায়িত খামারে অধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া মানুষের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক হুমকী। তারপরও খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমছে না।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়ার পরেও গত ৫০ বছরে নতুন জুওনটিক রোগের সংখ্যা বেড়েছে। গত ৫০ বছরে প্রায় ২৪০টি নতুন জুওনটিক অনুজীবের সংক্রমণ ঘটেছে। এর মধ্যে ৭৫% বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে ছড়িয়েছে। কারণ বন্যপ্রাণীর দেহে এমন অনেক অপরিচিত ভাইরাস থাকে যা মানব দেহে প্রবেশ করে অভিযোজিত হয়ে ভয়ঙ্কর রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। যেমন: সার্স, মার্স, ইবোলা, জিকা, নিপা, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদি। এই রোগগুলোর মৃত্যহার কোভিড-১৯ থেকেও বেশি।
পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস স্বাস্থ্য ঝুকি তৈরী করে
জুওনটিক ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হল অত্যাধিক মাত্রার চাষাবাদ এবং মাইনিং। কৃষিকাজ ও খামারের জন্য বন-জঙ্গল ধ্বংস করতে হয়- ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল পরিবর্তিত এবং বিনাশিত হয়। এর ফলে বন্যপ্রানী, খামারের পশু ও মানুষের মধ্যে সংযোগের সুযোগ বেড়ে যায়। মুনাফাকেন্দ্রিক খনিজ তেল এবং খনিজ পদার্থ শিল্পের কারণে জনশূন্য ভূমিতে মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়।
২০১৪ সালে আফ্রিকার দেশ গিনির গুয়োকেডু বন এলাকায় ভয়ঙ্কর ইবোলার বিস্তার ঘটে। ইবোলা রোগের মৃত্যহার ৫০-৯০%। মহামারীর কিছুদিন আগেই মাইনিং ও কাঠ সংগ্রহের জন্য ওই এলাকার ব্যাপক পরিমাণে বন উজাড় করে দেওয়া হয় [2]। ফলে স্থানীয় মানুষদের সাথে অন্যান্য বন্যপ্রাণীর, যেগুলো ক্ষতিকর ভাইরাস বহন করে যেমন: বাদুড়, শিম্পাঞ্জি, প্রত্যক্ষ সংযোগ বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী উপ-সাহারা অঞ্চলে যেসব এলাকায় বন উজাড় করে দেওয়া হয়েছে, সেসব এলাকায় ইবোলার বিস্তার ঘটার সম্ভাবনা বেশি। ২০০১-২০১৪ এর মধ্যে প্রায় ২৭ বার ইবোলার বিস্ফোরণ হয় এবং এর মধ্যে ২৫টি এমন এলাকায় হয়েছে যেখানে নিকটবর্তী অতীতে বন উজাড়িত হয়েছে [3]।
গত কয়েক বছরে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সাইবেরিয়া ইত্যাদি দেশে প্রচুর বন ধ্বংস করা হয়। “গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ” এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ সালে প্রায় ১.২ কোটি হেক্টর বন আমরা হারিয়েছি, যা বেলজিয়ামের আয়তনের সমান। গত বছর আমাজন বনে অনেকবার দাবানল হয়। বেশিরভাগই মানবসৃষ্ট- স্থানীয় ও কর্পোরেট জমিদারদের দ্বারা সৃষ্ট। এগুলো বলসোনারোর (ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট) ডানপন্থী পুঁজিবাদী সরকারের মদদেই সংঘটিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় সৃষ্ট দাবানলের কারণে প্রায় ১ কোটি হেক্টরের বন পুড়ে গিয়েছিল। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে দাবালন ও খরা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বন-জঙ্গল ধ্বংস হলে বন্যপ্রানী মানব সমাজে প্রবেশ করে এবং উদীয়মান রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
নগরায়ন, দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন
নগরায়ন এবং দুর্বল অবকাঠামো সংক্রামক রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। ইঁদুর, মাছি এবং মশা বিভিন্ন রোগ বহন করে। গরীব এলাকা যেখানে অবকাঠামো, পয়ঃনিস্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবে রয়েছে, সেখানে বাহকগুলোর প্রাদুর্ভাব বেশি। গত ৫০ বছরে বছরপ্রতি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বেড়েছে। এশিয়া অঞ্চলে দ্রুত নগরায়নের কারণে ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।
২০১৫ সালে জিকা ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছিল বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। জিকা ভাইরাস ১৮-৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিস্তার লাভ করতে পারে। ফলে উচ্চ তাপমাত্রা সম্পন্ন মৌসুমি এলাকাগুলোতে জিকা ভাইরাস সফলভাবে রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১৫ সালে ব্রাজিলে রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা ছিল, তাই পুরো বছরজুড়ে জিকা ভাইরাস বিস্তৃত হতে পেরেছিল। ডেঙ্গু ও জিকা উভয় ভাইরাসের জন্যই গরম আবহাওয়া অনুকূল।
অবকাঠামো এবং সুযোগ সুবিধার অভাব শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা নয়। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের ফ্লিন্ট শহরে বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা গিয়েছিল সীসা দূষণের কারণে। সম্প্রতি ইসরাইলে জলাতঙ্ক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গিয়েছিল কৃষি মন্ত্রনালয়ের পশু স্বাস্থ্য বিভাগে বরাদ্দ কমানোর কারণে। দুই বছর আগে ইসরাইল প্রশাসন শেয়াল ও খেকশিয়াল টিকা কর্মসূচি বাতিল করে দিয়েছিল। গত দুই দশকের নব্য-উদারবাদী পলিসির কারণে যুক্তরাজ্যে বর্জ্য সংগ্রহকর্মীদের প্রণোদনা কমানো হয়েছে। ফলে তারা বারবার ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়।
পুঁজিবাদঃ একটি স্বাস্থ্য ঝুঁকি
সাধারণভাবে বন উজাড় ও পরিবেশ দূষণ আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হয় বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানদের অধিক মুনাফার লোভের কারণে। গত ৩০ বছরে মোট গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ৭০ ভাগের জন্য ১০০টি কর্পোরেশন দায়ী। অর্থাৎ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান দায়ভার তাদের উপর বর্তায়।
পৃথিবীজুড়ে মহামারীর আবির্ভাব আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় মানুষের চাহিদার উপর ভিত্তি করে গনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক উপায়ে উৎপাদনের প্রয়োজনীতা, মুনাফার উপর ভিত্তি করে নয়। খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন বড় বড় কর্পোরশনের মালিকানা থেকে সরিয়ে সামাজিক মালিকানায় হস্তান্তর করতে হবে যাতে শুধুমাত্র মানুষের চাহিদার উপর ভিত্তি করে খাদ্য উৎপাদন হয়। ফলে খাদ্য সামগ্রী অপচয়ের পরিমাণ কমে যাবে এবং পরিবেশের অনুকূল উৎপাদন ও বিতরণ সম্ভব হবে। একই সাথে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমানোর জন্য টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানীর দিকে ধাবিত হতে হবে। কিন্তু কৃষির মত এই সেক্টরের প্রধান সমস্যা জ্বালানী নিয়ন্ত্রণ করা কোম্পানীগুলো কর্পোরেটদের হাতে। অর্থাৎ দেশের জ্বালানী কোম্পানিগুলোকে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে হবে। এর ফলে মাইনিং ও বন-জঙ্গল ধ্বংসের পরিমাণও কমে যাবে। এছাড়া অবকাঠামো খাতে প্রচুর পরিমাণে বরাদ্দ দিতে হবে।
অর্থাৎ পরিবেশগত সংকট মোকাবেলা করতে হলে সমাজ কাঠামোয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মূল কথা হল মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন নিষিদ্ধ করে শুধুমাত্র চাহিদার উপর ভিত্তি করে গনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উৎপাদন করতে হবে। একই সাথে উৎপাদিকা শক্তি সামাজিক মালিকানায় আনতে হবে। ফলে পরিবেশ ধ্বংস হওয়া রোধ করতে হলে আমাদেরকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কারণ শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজে, যেখানে উৎপাদিকা শক্তি শ্রমিকের হাতে থাকবে, পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি না করে উৎপাদন সম্ভব। শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজেই মুনাফার পরিবর্তে জনমানুষের চাহিদা ও স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার পাবে।
রেফারেন্স:
1.https://www.nature.com/articles/s41591-020-0820-9
2.https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4117598/
3.https://www.nature.com/articles/s41598-017-14727-9
[এই নোটটি অস্টেলিয়ার বামপন্থী সংগঠন “socialist alternative” এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের অনুবাদ]

Post a Comment

0 Comments