লিখেছেন
আরাফাত সাদ
ছবির সূত্রঃঃ দৈনিক যুগান্তর |
পুরো পৃথিবীতে গুজবের ভাইরাস সবাইকে আক্রান্ত করেছে। বেশির ভাগ গুজব পুরোপুরি মিথ্যা হয় না, বাস্তবতার সাথে কিছু মিল রেখে তথ্য খুবই চমকপ্রদভাবে উপস্থাপন করা হয়। এধরনের গুজবকে বলা হয় পুনর্নিমিত গুজব। যেমন: দিনে তিন কাপ গরম চা খেলে করোনাভাইরাস আক্রান্ত করতে পারবে না। কারণ হল উচ্চতাপমাত্রা ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সোশ্যাল মিডিয়া এই ভুল তথ্য ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়। এরকম পুনর্নিমিত গুজবের প্রধান সমস্যা হল এগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা। বাস্তবতার সাথে মিল থাকায় বিশ্বাস করা সহজ হয় কারণ যখন আমরা এই ধরনের গুজব শুনি তখন মস্তিষ্কে এক ধরনের False memory তৈরী হয়। False memory এর কারণে গুজবের সাথে আমাদের সম্পর্ক তৈরী হয় এবং কেনো ধরনের চ্যালেঞ্জ ছাড়াই আমরা সেটা গ্রহণ করি। যেমন: ধরনের আপনি কোনো উৎস থেকে জানতে পারলেন যে গরম লবণ পানি দিয়ে গরগরা করলে ভাইরাস আপনাকে সংক্রমিত করতে পারবে না। তখন আপনার মস্তিষ্কে থাকা বাস্তব তথ্যের- উচ্চ তাপমাত্রায় ভাইরাস মারা যায়- সাথে গুজবের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক তৈরী হবে এবং আপনি কোনো প্রকার ক্রসচেক না করেই সেটা বিশ্বাস করা শুরু করবেন। আধুনিক যুগে পুনর্নিমিত গুজবই বেশি ছড়ানো হয়। এরকম আরো উদাহরণ হল ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সাজেশন, ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে ভাইরাস তাড়ানো, কোভিড-১৯ এর ঔষধ হিসেবে কালোজিরা ইত্যাদি।
আরেক ধরনের গুজব হল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য হল ঘটনাকে কর্তৃপক্ষ, বিশেষজ্ঞ, চিহ্নিত শত্রু বা আশেপাশের মানুষের তৈরী ষড়যন্ত্র হিসেবে ব্যাখা করা। চীনে নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন: ওয়াশিংটন টাইমস, জিরোহেজ ইত্যাদি প্রমাণসহ দাবী করে যে চীন এই ভাইরাস ল্যাবে উৎপন্ন করে ছড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সিনেটররাও এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করেছে। আস্তে আস্তে এই গুজব আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় এক চাইনিজ মহিলার বাদুড় স্যুপ খাওয়ার ভিডিও ছড়ানো হয়। ভিডিও এর ক্যাপশন অনু্যায়ী সেই মহিলা স্যুপ খেয়ে প্রথম নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং উনার থেকেই পুরো পৃথিবীতে ছড়ায়। এই ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যাপক মাত্রায় ছড়ানো হয়েছে আমাদের দেশে।
গুজবের প্রাদুর্ভাবের কারণ বোঝার জন্য গুজবের ধরনের মত গুজবের উৎসের গতিপ্রকৃতি জানাও আবশ্যক। আমাদের দেশে গুজব শুরু হয় প্রধানত বিশ্বস্ত মাধ্যম থেকে যেমন: ওয়াজ, তারকা, শিক্ষক, সরকারী কর্মকর্তা, মন্ত্রী। মার্চের শুরুতে কোভিড-১৯ এর প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছিল। একদম শুরুতে তারা এই মহামারীকে আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর গজব বলে প্রচার করা শুরু করে। পরে মুসলিম দেশগুলো আক্রান্ত হওয়া শুরু করলে তারা সেই ন্যারেটিভ বন্ধ করে দেয়। মহামারীর কারণে বিভিন্ন মুসলিম দেশ মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করলে, এদেশের কিছু আলেমরা “নামাজ পড়তে গেলে ভাইরাস ছড়াবে না” বলে ঘোষণা দেয়। মসজিদ বন্ধ করলে রাজপথে নামার হুমকী দেয় কেউ কেউ। ইসলামে সংক্রামক রোগের অস্তিত্ত্ব নেই বলে প্রচারও করা হয়। কেউ কেউ কালোজিরা গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টা হল অনেক মানুষ এই ধরনের গুজব আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করে বসে। এই প্রবণতার অনেকগুলো কারণ রয়েছে-
১। আবেগপ্রবণতা ও বিশ্বস্ততা:
যে গুজব আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলোই বেশি বিশ্বাসযোগ্য। আপনি আপনার প্রতিবেশির কাছ থেকে যদি শুনতে পান মহামারী প্রতিরোধের উপায় পাওয়া গিয়েছে, তাহলে আপনি অবশ্যই স্বস্তি পাবেন এবং যেহেতু আপনার প্রতিবেশী বিশ্বস্ত তাই হয়ত কোনো প্রকার যাচাই না করেই সেটা বিশ্বাস করে বসবেন। এ কারণেই ওয়াজের আলেম বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গুজব ছড়ালে সেটা বেশি মানুস বিশ্বাস করে। তারা একইসাথে বিশ্বস্ত এবং আবেগপ্রবণ ভাষায় কথা বলতে পারে। যেমন: মসজিদে গেলে করোনা হয় না এবং ইথানলের বাষ্প গ্রহণ করলে রোগমুক্তি পাওয়া যায়।
২। অশিক্ষা ও কুশিক্ষা:
বাংলাদেশে কাগজ কলমে স্বাক্ষরতার হার ৭০% হলেও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে এইচএসসি পর্যন্ত পড়লেই ৭০% এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এইচএসসি পর্যন্ত পড়লেই সে সুশিক্ষিত নয়। এ কারণেই নিম্নবিত্তরা- যে শ্রেণীতে শিক্ষার হার সবচেয়ে কম- সবচেয়ে বেশি গুজবের শিকার হয়। এছাড়া আমাদের কারিকুলাম শিক্ষিত জাতি গড়ার ক্ষেত্রে খুবই অনুপযোগী। কারণ এখানে বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর জোর দেওয়া হয় না। পুরো বিশ্বের সব ঘটনা শুধুমাত্র বিজ্ঞান দিয়েই ব্যাখা করা যায়। কারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুযায়ী প্রথমে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, তারপর অনুসিদ্ধান্ত তৈরী করে আরো অনেকবার পর্যবেক্ষণ করতে হয় এবং পরীক্ষণের মাধ্যমে সেই পর্যবেক্ষণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রেপ্লিকেট করতে হয়। তারপরই তত্ত্ব বা সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার নতুন প্রমাণের আলোকে সেই তত্ত্ব আংশিক বা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে হয়। গণমানুষে বৈজ্ঞানিক চিন্তাপদ্ধতি গড়ে উঠে নায় বলে তারা সহজেই গুজবে বিশ্বাস করে। আমাদের দেশে জোর দেওয়া হয় চাকরীর উপর, ভবিষ্যৎ দাসত্বের উপর। এ কারণে শিক্ষিত লোকেরাও গুজব ছড়াতে ভূমিকা রাখছে।
৩। কর্তৃপক্ষের উপর অবিশ্বাস:
পাঁচ বছর বছর পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়। তারা মানুষকে নতুন নতুন আশা দেখিয়ে ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু গদি পাওয়ার পর সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। গরীব আরো গরীব হয় এবং ধনীরা আরো ধনী হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সেই নির্বাচনও ঠিক মত হয় না। ফলে সামগ্রীকভাবে কর্তৃপক্ষের উপর বিশ্বাস হ্রাস পেতে থাকে। ফলে কর্তৃপক্ষ যতই সত্য প্রকাশ করুক না কেনো, সবাই সেটা আড়চোখে দেখে।
কিছু গুজব বাস্তবে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না, কিন্তু কিছু গুজব মানুষের মৃত্যও ঘটাতে পারে, অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব তো আছেই। তাই এই ভাইরাস প্রতিরোধ করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেটা করা যাবে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রসার ঘটিয়ে।
0 Comments