পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ শূন্য থেকে মহাবিশ্ব( লিখেছেন তানজিলা ইসলাম ঋতু )

যেখানে কিছুই নেই,সেখানেই সবকিছু...

শূন্য থেকেই অসীম....

কিন্তু কিভাবে?



'শূন্য থেকে মহাবিশ্ব' বইটি গণিতের শূন্য থেকে পাঠককে নিয়ে যাবে পদার্থের শূন্যের গহ্বরে। শুরু থেকে শেষ অবধি মনে হয়েছে এযেন এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা। শূন্যতাকে দেখব এখানে ভিন্ন ভিন্ন চোখে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে, শূন্য আর অসীমের মেলবন্ধনে। 

প্রাচীনকালে গণিতের, জ্যামিতির অনেক অগ্রগতি হলেও শূন্য তখনও কারও কল্পনার দুয়ারে করাঘাত করেনি। কারণ প্রাত্যাহিক জীবনে এর ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। কোনো চাষী তো 'শূন্য' সংখ্যক বীজ বপন করেনা বা শূন্য সংখ্যক গরু তো কারও গোয়ালে থাকেনা। তাই শূন্যের গুরুত্বটুকু উপলব্ধি করতে মানবজাতির অনেক যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। 

অপেক্ষার একসময় অবসান হল। তবে সেকালে জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে থাকা মিশর বা গ্রিকরা নয়, শূন্যের জন্ম হল প্রথম ব্যবিলনীয়দের হাত ধরে(তারাও জ্ঞানবিজ্ঞানে পিছিয়ে ছিল না, বরং কিছু দিকে থেকে এগিয়েই ছিল)। যদিও সেটাকে শূন্য না বলে শূন্যজাতীয় কিছুই বলা উচিৎ। ধীরে ধীরে সেটি রূপ নিল সত্যিকারের শূন্যে। তবে শূন্য যেন হয়ে দাড়াল গ্রিকদের ঘোরশত্রু। তাঁরা কিছুতেই শূন্যকে গ্রহণ করবেন না। তাদের কাছে শূন্য শয়তানের অধম, কারণ শূন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব ধ্বংস করে, অস্বীকার করে।

আবার অসীম বলতে কেবল ঈশ্বরকেই বোঝায়,বাকিসব সীমার মাঝে গন্ডিবদ্ধ। তাই গ্রিকদর্শনে এদুটোই ছিল তাদের বিশ্বাসের পরিপন্থী। 

তাই যেকরেই হোক শূন্যকে রুখে দিতে হবে। এই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল গ্রিক পন্ডিতরা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন মহামাতি পীথাগোরাস।তার দর্শনে শূন্যভীতি তো ছিলই, এছাড়াও তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন জগতের সবকিছু সুন্দরের মূলে আছে মূলদ সংখ্যা,আর যত কুশ্রী,বেসুর তার মূলে আছে অমূলদ সংখ্যা। 

    
পিথাগোরাস 

তার এই বিশ্বাস উগ্র ধর্মবিশ্বাসে রূপ নিল। এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কেউ গেলে তিনি তাকে মৃত্যুদন্ড দিতেও ভাবতেন না।

কিন্তু একসময় দেখা গেল সংসারের সবচেয়ে মধুর সুন্দর দৃ্শ্যের সাথে জড়িত সংখ্যাটি আসলে অমূলদ। যাকে আমরা বলি কিনা গোল্ডেন রেশিও।

পীথাগোরাস পরলেন মহা বিপদে। এই কথা কেউ জানলে যে তার এতদিনের দর্শন মূহুর্তেই ভেঙ্গে পরবে। তাই গোপনভাবেই তার সঙ্ঘ তিনি চালিয়ে গেলেন। কেউ সত্য প্রকাশ করতে চাইলেই তার হত করুণ পরিণতি।

পরবর্তীতে প্লেটো, আ্যরিস্টটলও শূন্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তবে যতই তারা শূন্যকে অস্বীকার করুক না কেন শূন্য তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছিল সর্বদাই।

আমরা জানি যথার্থ পরিবেশ না পেলে কোনো বড় সৃষ্টি সম্ভব নয়। শূন্যকে আপন করে নেয়ার যথার্থ পরিবেশ ছিল যেন ভারতবর্ষে। ধারণা করা হয় আলেকজান্ডার খ্রি:পূ:৪র্থ শতকে ভারতবর্ষ আক্রমন করলে তারা ব্যবিলনেরর শূন্যের সাথে পরিচিত হয় এবং আয়ত্ত করে নেয়। 

তাদের ধর্মের সাথেই শূন্য ও অসীম জড়িত। হিন্দু ধর্মের সেরা ভগবান ব্রহ্মা। তিনিই স্রষ্টা, তিনিই সংহারক। শূন্যতায় বিলীন, আবার সর্বব্যাপী তার উপস্থিতি। শূন্যই তাদের ঈশ্বর।

তাই ভারতবর্ষের মাটিতে শূন্যের ব্যবহার নতুন জীবন পায়। শুধু ফলক হিসেবে কেন, সংখ্যা হিসেবে ব্যবহার হতেই দোষ কোথায়!

অচীরেই কয়েক শতাব্দীর মাঝেই শূন্য তাই স্থান করে নেয় তাদের বর্ণমালাতে। চীনেও প্রায় একইসময়ে শুরু হয় শূনের ব্যবহার।

ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ব্রহ্মগুপ্ত তার বইয়ে শূন্যকে সত্যিকারের সংখ্যার মর্যাদা দেন। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে আর্যভট্টও শূন্যকে স্বতন্ত্র সংখ্যার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার সাথে শুরু হয় ঋণাত্মক সংখ্যার ব্যবহার। ৪০০-১২০০ সাল ভারতের গণিতের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ ছিল।

ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষনে মোহাম্মদ(সাঃ) এর অনুসারী আরব বাহিনী তাদের দিগ্বিজয়ের সীমানা বহুদুর বিস্তৃত করে ফেলে। তবে তারা শুধু ধর্মবিস্তার আর সাম্রাজ্যবিস্তার করেই ক্ষান্ত হননি, তারা বিজিত জাতির জ্ঞানভান্ডারও আহরণ করে এনেছেন। মূলত খলিফা হারুন-অর-রশিদের ছেলে আল মামুনের শাসনামলে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটে। তিনিই ছিলেন মুসলিম জগতের প্রথম সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর হোতা। আল মামুনের সময়ই মোতাজিলা মতবাদের উদ্ভব  হয় । তারা মনে করতেন সংসারের কোনোকিছুই প্রশ্নাতীত নয়, ধর্মও নয়। কোরআনকে তারা পবিত্র গ্রন্থ মানতেন ঠিকই, কিন্তু এটাও মানতেন যে যুগবিশেষে এর রদবদল সম্ভব ও সংগত।

      
আল খোয়ারিজমি  


সে সময়ের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রিক, ইহুদী, খ্রিষ্টানদের যা গ্রন্থ ছিল সব আরবীতে অনুবাদ করেন। তারপর নিজেরাই লেগে পরেন জ্ঞানচর্চায়। তাদের প্রচেষ্টায় ইসলামি মেধা পল্লবিত হয়ে ওঠে। তার অন্যতম নায়ক ছিলেন আল-খোয়ারিজমি(৭৮০-৮৫০) নামে এক গণিতপ্রেমী।

আজ ইতিহাস তাকে জানে বীজগণিতের স্রষ্টা হিসেবে। তিনি দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। এবং সমীকরণে ০ এর ব্যবহার নিয়ে আসেন।

আবার ওমর খৈয়াম ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। যেখানে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সংখ্যার মেলবন্ধন হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে শূন্য। 

দার্শনিক মহলে কিন্তু তখনও শূন্য পুরোপুরি স্থান গেড়ে নেয়নি। কারণ তখনও তাদের আ্যারিস্টটলীয় ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। শূন্যের সাথে নিরীশ্বরবাদীতার একটা সম্পর্ক আছে, এই অস্বস্তি তাদের কাটছিল না।

তবে গণিতের অগ্রগতি তাদের এই অমূলক বিশ্বাসের ভিত্তি দূর্বল করে দিচ্ছিল। 'শূন্য' কেবলই একটা সংখ্যা, তার কম বা বেশি নয়। শূন্যের সাথে ঈশ্বর আছে কি নেই তার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা, এই বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি তাদের কাছে ধীরে ধীরে গ্রহনযোগ্য হতে থাকে।

প্রকৃতিতে ফিবোনাচ্চি নাম্বার



চিত্রে ফিবোনাচ্চি নাম্বার


  প্রাচ্যের শূন্যকে ইউরোপে আর বেশিদিন চেপে রাখা গেলনা। আগন্তুকের মত শূন্য ও আরব গণিত ইউরোপে এল লিওনার্দো ফিবোনাচির হাত ধরে। তিনি তার সমীকরণে জানান দিলেন অসীমের উপস্থিতি। 

সেই সময়ের চিত্রশীল্পিরা এই চিন্তা লুফে নিল। ব্রুনোলিসি প্রথম তার ছবির সাথে মিলিয়ে দেন শূন্য ও অসীমের ধারণা। পরবর্তীতে রেঁনেসার অন্যতম কর্ণধার ভিঞ্চি এটি তুলে ধরেন। সেসময়ের শবদেহের মত ছবিগুলো যেন শূন্যের ছোঁয়ায় প্রাণ পেল। চিত্রের জগতে স্থান করে নিল গণিতের ক্যারিশমা। তাদের শিল্পে গোল্ডেন রেশিও আত্মপ্রকাশ করতে লাগল। পীথাগোরাসের সেই অমূলদ সংখ্যাটি!

ব্রুনোলিসির ছবিতে শূন্য ও অসীম হাত ধরাধরি করে স্থান নিয়েছিল। সাথে আরও কিছু কারণে চার্চের মন আ্যরিস্টটল-বিরোধী ধারণার প্রতি নরম হতে লাগল। ফলে আরও কিছু জ্ঞানীগুণী জন সাহস নিয়ে এগিয়ে এলেন তাদের মতবাদ নিয়ে।তারই একজন ছিলেন নিকোলাস কোপার্নিকাস(১৪৭৩-১৫৪৩)। তিনি টলেমী, পীথাগোরাস আর এরিস্টটলের ভূকেন্দ্রিক মতবাদ উৎখাত করে দিয়ে বলেন সূর্যই এই সৌরজগৎ এ একমাত্র স্থির নক্ষত্র, বাকি সব গ্রহ এমনকি পৃথিবীও তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তবে যে বছর তার এই বিপ্লবী তত্ত্ব প্রকাশিত হয়, সে বছরই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। বেঁচে গেছেন বলা যায়।

তবে কোপার্নিকাস চার্চের বহ্নি থেকে রক্ষা পেলেও রক্ষা পেলেন না জিওদার্নো ব্রুনো। সূর্যকেন্দ্রিক মডেল প্রচারের অপরাধে তাকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করা হয়। 

এই ভয়াবহ পরিণতির পরও সত্য থেমে থাকেনি। কেপলার গ্যালিলিও নিউটনের হাত ধরে বারবার ফিরে এসেছে। 

নিউটন দুটি বস্তুর যেই আকর্ষণের কথা বলেছেন, সেটি কেন্দ্রিক। সেই কেন্দ্র শব্দটিতেই আছে শূন্যের আভাস। তার আবিষ্কৃত ক্যালকুলাসে লুকিয়ে ছিল শূন্য, যেটা তিনি তখন বুঝতে না পারলেও আমরা হরহামেশাই দেখতে পাচ্ছি।

অন্যদিকে সেই সময়ের দর্শন মহলেও শূন্য স্থান পেতে লাগল। যেখানে এরিস্টটলরা শূন্য ও অসীমকে অস্বীকার করে ঈশ্বরকে খুঁজতে চেয়েছেন, সেখানে দেকার্তের মত দার্শনিক শূন্য ও অসীমের মাঝেই স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন।


মোট কথা শূন্যের একটা ঠিকানা অবশেষে হল। বাস্তবে না হোক গণিতের খাতায়, বা দর্শনেও হয়ত। কিন্তু এবার বাস্তবে শূন্য খুঁজে ফেরার পালা।

সেসময় টরিসেলি বায়ুর চাপে খুঁজে পেলেন শূন্যস্থানের উপস্থিতি। আবার প্যাস্কেল তার বিখ্যাত প্রবেবিলিটির সূত্রেও শূন্যকে এনে দেন দৈনন্দিন জীবনে। ওদিকে ক্যালকুলাসের লিমিট যেন শূন্যের সঙ্গে স্পর্শ কিন্তু শূন্য নয়। তাই বলা যায় প্রকৃতিতে শূন্যের দেখা মিলল।


বস্তুর রসায়নে কি শূন্যের উপস্থিতি আছে? এটাই যেন দেখালেন বিজ্ঞানী চার্লস। তিনি বললেন, TœV। এবং বস্তুর তাপমাত্রা কমতে কমতে শূন্যে পৌঁছালে বস্তুও অস্তিত্বহীন হয়ে পরবে। 

এই তাপমাত্রাকে বলে পরম শূন্য তাপমাত্রা। অর্থাৎ প্রকৃতির একটা সহ্যসীমা আছে, এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানেই শূন্যের অবস্থান।


সেই সময় ম্যাক্স প্লাংক নিয়ে এল কণাজগতের এক যুগান্তকারী তত্ত্ব। যার নাম 'কোয়ান্টাম তত্ত্ব'। এই তত্ত্ব অনুযায়ী শূন্য মানেই শেষ নয়,শূন্য তেজেরও একটা অর্থ আছে। বরং বলা যায় শূন্য লেভেলের যে সঞ্চিত শক্তি, মহাবিশ্বের জানা অজানা সকল শক্তি একত্র করলেও তার সমান হবেনা।

এটাই আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E=mc^2 এর বাণী। একটা স্থির বস্তু, m ভরবিশিষ্ট সামান্য একটি কণা, যার তেজ শূন্যতে নেমে গেছে তারও সঞ্চিত শক্তি ডানপাশের বিপুল সংখ্যাটি। 

আইনস্টাইন দেখিয়ে দিলেন শূন্যেরও কি অসীম ক্ষমতা!

কোয়ান্টাম তত্ত্বের এই অভিনব সংযোজনের মাঝে শ্রোডিঞ্জার নিয়ে এলেন তার সম্ভাবতার ওয়েভ ফাংশন। একটা ফ্যান যখন তার সর্বোচ্চ গতিতে ঘোরে তখন যেমন তার পাখার অবস্থান নির্ণয় অসম্ভব হয়ে ওঠে। তেমনি কণা জগতের কুজ্বটিকায় শ্রোডিঞ্জারের ওয়েভ ফাংশন সেই সম্ভাবনারই একটা সংখ্যা দাড় করায়।

এর সাথে এল হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব। যার মূল হল কখনোই একটি কণার অবস্থান ও ভরবেগ একসাথে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। 

এরই সাথে আমরা পাই আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব। যেখানে তিনি সময়কে দেখান আপেক্ষিক হিসেবে। এবং গতি বাড়ার সাথে সাথে যে পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে দৈর্ঘ্য, ভর ও সময়ের পরিবর্তন হয় তা তিনি দেখালেন। 

পরবর্তীতে তিনি আপেক্ষিকতার সাহায্যে দেখালেন মহাকর্ষকে শুধু দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল হিসেবে দেখলে হবেনা, বরং বিশাল ভরের কারণে মহাশূন্যে তৈরি হয় বক্রতা যা বস্তুকণা তো বটেই আলোক কাণিকাকেও বাঁকিয়ে দেয়। এইত গেল আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কথা।


তবে মহাবিশ্বের সূচনাটা হল কিভাবে?

আমরা সকলেই প্রায় জানি 'বিগ ব্যাং' নামের এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয় এই মহাবিশ্বের যাত্রা। প্রায় ১৩৮০ কোটি বছর আগে অতি উত্তপ্ত ও অসীম ঘনত্বের এক পুঞ্জীভূত অবস্থা থেকে বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে উদ্ভব হয়েছে মহাবিশ্বের। ধারণা করা হয়, সেই সময় চার বল একত্রে মিশে ছিল। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় আমাদের গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ,উপগ্রহের।

বিগ ব্যাং


কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ১০ টি নতুন সমস্যার সৃষ্টি না করে কোনো সমস্যার সমাধান হয়না। এক্ষেত্রেও তাই হল। যেমন বিগ ব্যাং ১৩০০ কোটি বছর আগে হয়েছে। কিন্তু আমরা ৯২০০ কোটি আলোকবর্ষের ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট মহাবিশ্ব দেখতে পাই। মহাবিশ্ব এত বড় হল কিভাবে? এটি কিভাবে সম্ভব?

এছাড়াও দিগন্ত সমস্যা, সামতলিক সমস্যা, মনোপল সমস্যা(একক মেরুবিশিষ্ট চুম্বক থাকার কথা, যা নেই) দেখা দিল।

এই সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে এলেন অ্যালেন গুথ নামের এক বিজ্ঞানী। তার স্ফীতি তত্ত্বের দ্বারা। এই তত্ত্বের মাধ্যমে উত্তর দেয়া হয়েছে শুরুতে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হয়েছে সূচক আকারে। ফলে মাত্র ১০^-৩৫ সেকেন্ডে মহাবিশ্বের আকার বেড়ে ১০^৩০ হয়ে গিয়েছিল।

এখানে জেনে নেয়া দরকার যে সামতলিক, বদ্ধ বা উন্মুক্ত মহাবিশ্ব কি? বদ্ধ মহাবিশ্ব হল এমন মহাবিশ্ব যা প্রসারিত হতে হতে একসময় মহাকর্ষের টানে চুপসে যাবে। আর উন্মুক্ত মহাবিশ্ব সবসময় প্রসারিতই হতে থাকবে। 

স্ফীতি তত্ত্ব দিগন্ত, সামতলিক সমস্যার সমাধান এনে দেয়। এলেন গুথ দেখান যে ওমেগার মান ১ হলে আমাদের মহাবিশ্ব হবে সামতলিক।

কিন্তু এখানে নতুন সমস্যা দাড়ায় ওমেগা নিয়ে। ওমেগা হল মহাবিশ্বের প্রকৃত ঘনত্ব ও সন্ধি ঘনত্বের অনুপাত। সন্ধি ঘনত্ব আবার কি? এটি হচ্ছে মহাবিশ্বকে বদ্ধ বা উন্মুক্ত মহাবিশ্বের মাঝে এমন এক ঘনত্ব যার ফলে মহাবিশ্ব হবে সামতলিক। 

মহাবিশ্বকে সামতলিক হতে হলে এই ওমেগার মান হতে হবে একদম ১। কিন্তু হিসেব করে মহাবিশ্বের মোট ঘনত্বের হিসেব কিছুতেই মিলছিল না। মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব পাওয়া যাচ্ছিল ক্রান্তি ঘনত্বের ১/৩ অংশ। সোজা কথায় আমাদের চেনাজানা পদার্থ আর গুপ্ত পদার্থ মিলে তা ছিল শতকরা ৩০ ভাগ। কিন্তু মহাবিশ্বকে সমতল প্রমান করতে আরও ৭০ ভাগ শক্তির দরকার ছিল। 

২০১৩ সালে বিজ্ঞানীদের একটি পরিক্ষার মাধ্যমে স্টিফেন হকিং ঘোষণা দিলেন যে মহাবিশ্বের হারানো গুপ্ত শক্তি আবিষ্কার করা গিয়েছে এবং এটি প্রমাণ করা গেছে যে মহাবিশ্ব সত্যিই সমতল।

তবে স্ফীতি তত্ত্ব যদি সত্যি হয় তবে সেই প্রচন্ড স্ফীতির কিছু রেশ আমাদের পাওয়ার কথা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আকারে। এই তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যাওয়া কণার নাম হল গ্রাভিটন। যেমন -তাড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যায় ফোটন কণা, ঠিক তেমনি।

কিন্তু মহাকর্ষ তরঙ্গ প্রচন্ড দূর্বল হওয়ায় এটি খুঁজে পাওয়া ছিল মুশকিল। কিন্তু ২০১৪ সালে জন কোভাকসহ কিছু বিজ্ঞানী মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করতে পেরেছে।

তাহলে যদি এই স্ফীতি তত্ত্ব সঠিক হয় তবে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব যতই অদ্ভুত শোনাক না কেন বাস্তবে কিন্তু তাই ঘটেছে। শূন্য বলতে যা বোঝায় পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় শূন্য তা নয়। শূন্যে নিহিত শক্তি থেকে পদার্থ তৈরি হতে পারে, আবার শক্তিতে বিলীনও হতে পারে। একে কোয়ান্টাম শূন্যতা বলে।

যেমন শূন্যাবস্থা থেকে সামান্য আলোর ঝলকানির মধ্যে ইলেকট্রন ও পজিট্রন থেকে পদার্থ তৈরি হয়েই আবার তা শূন্যতায় মিলিয়ে যেতে পারে। এই ব্যাপারটাকে বলে 'ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন'।

মহাবিশ্বে মোট ধনাত্মক শক্তি ও ঋণাত্মক শক্তি সমান। ধনাত্মক শক্তি থেকে বস্তু তৈরি হয় আর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের রয়েছে ঋণাত্মক শক্তি। 

অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টির আগেও মোট শক্তি ছিল শূন্য এবং পরেও মোট শক্তি শূন্য।

তাই বিজ্ঞানীরা আজ মনে করেন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে মহাবিশ্বের উদ্ভব আর তারপর স্ফীতির মাধ্যমে এই দানবীয় প্রসার। শুরুর দিকে ছিল একটি শূন্যস্থান, যার মধ্যে ভ্যাকুয়াম এনার্জী শুরুর দিকে ছিল একটি শূন্যস্থান, যার মধ্যে ভ্যাকুয়াম এনার্জী লুকিয়ে ছিল।

অর্থাৎ একদম প্রাকৃতিক উপায়েই এই মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে। এরজন্য কোনো দৈব শক্তির প্রয়োজন নেই।একই ভাবে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন স্ফীতির স্কেলার আমাদের ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্ব উপহার দিতে পারে। যেখানে হয়ত কাজ করবে ভিন্ন ভিন্ন পদার্থবিদ্যার সূত্র।

অর্থাৎ আমরা একা নই। থাকতে পারে আমাদের মত এমন অসংখ্য মহাবিশ্ব। তাদের থাকতে পারে নিজস্ব নিয়ম। বদ্ধ বা উন্মুক্ত যেকোনো প্রকার মহাবিশ্ব। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যদি ভ্যাকুয়াম থেকে তৈরি হওয়া এমন অসংখ্য মহাবিশ্ব আমাদের চারপাশে থাকে, যাদের আমরা মাল্টিভার্স বলি তাহলে নিশ্চয়ই তাদের সাথে আমাদের মহাবিশ্বের কখনো না কখনো ধাক্কা লাগবে। বিজ্ঞানীরা এমন কিছু ধাক্কার অস্তিত্বও পেয়েছেন।যদিও সেগুলো এখনও ওতটা প্রমাণিত নয়। তবুও এখন মাল্টিভার্সের ধারণা কল্পকাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি হয়ে উঠছে পদার্থবিজ্ঞানের মূলধারার গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

তবে এই কোয়ান্টাম শূন্যতার সাথে জড়িয়ে আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। যাকে আমরা হিগস ক্ষেত্র বলি। আগেই বলেছি কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় শূন্যতা জিনিসটা আদতে শূন্য নয়। যেকোনো কণা-পদার্থবিদকে এই কথা বললে তিনি বলবেন ভ্যাকুয়াম জিনিসটা হিগস ক্ষেত্রে ডুবে আছে। মহাবিশ্বের সর্বত্র এটি বিদ্যমান। হিগস না থাকলে মহাবিশ্বের চেহারা কেমন হত, এনিয়ে কথা বলার মত কেউ আদতে তখন থাকত কিনা এটাও বড় প্রশ্ন। যদি হিগস ক্ষেত্র বলে কিছু না থাকত তবে কোনো বস্তুকণারই ভর বলে কিছু থাকত না তা সে ইলেকট্রনই হোক আর যেই হোক!

হিগস আছে বলেই আজ আমাদের গ্রহ নক্ষত্র গাছপালা ভর অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেও সমস্ত অস্তীত্বহীনকে অস্তিত্ব দানকারি এই হিগস কণার অস্তিত্ব সহজে ধর‍তে পারছিলেন না।

তবে অবশেষে ২০১২ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় "সার্ন" খুঁজে পায় হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব।

[মিডিয়ায় এই কণাকে ঈশ্বর কণা বলে প্রচার করা হলেও বাস্তবে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার সাথে এই কণার কোনো সম্পর্ক নেই। ]

তবে মহাবিশ্বের গ্রহ নক্ষত্র সহ ৪ ভাগের ভর হিগস থেকে এলেও বাকি ৯৬ ভাগ গুপ্ত শক্তি ও গুপ্ত পদার্থের ভর কোত্থেকে এল তার সাথে হিগসের কোনো সম্পর্ক আছে কি নেই তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও পরিষ্কার নয়।

এ তো গেল মহাবিশ্ব সৃষ্টির গল্প, তৈরির গল্প, চেনাজানা বস্তুজগৎ আর অজ্ঞাত শক্তির গল্প। 

তবে কি হবে এই মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি?

আমরা আগেই জেনেছি যে মহাবিশ্বের ঘনত্ব সন্ধি ঘনত্বের চেয়ে বেশি হলে মহাবিশ্ব হবে বদ্ধ, কম হলে হবে উন্মুক্ত। এই দুইয়ের মাঝে হলে হবে সামতলিক মহাবিশ্ব।

এই ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে মহাবিশ্বের তিন পরিণতি হতে পারে। বাংলাদেশের অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তার বই "The ultimate Fate of the universe" বইয়ে এটি উল্লেখ করেন। 

    
জামাল নজরুল ইসলাম

তিনি বলেন ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে মহাবিশ্বের তিন পরিণতি হতে পারে।

১.মহাসংকোচন: এই মতবাদ অনুযায়ী একসময় মহাবিশ্ব সংকুচিত হয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই আবার শূন্যে ফিরে যাবে।

২.মহাশৈত্য: এই মতবাদ অনুযায়ী ট্রিলিয়ন বছর পর মহাবিশ্বের সকল নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটবে। অর্থাৎ প্রসারিত হতে হতে একসময় মহাবিশ্বের তাপীয় মৃত্যু ঘটবে। 

৩.মহাচ্ছেদন: মহাবিশ্ব আজীবন প্রসারিত হতেই থাকবে। 


এর যেকোনো একটিই ঘটতে পারে আমাদের মহাবিশ্বের ভাগ্যে। তবে কি ঘটবে সেটি নিয়ে এখনও বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়! 

কেন মহাবিশ্বে কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?

আগে ভাবা হত নাথিং ব্যাপারটা হচ্ছে বস্তুর স্বাভাবিক অবস্থা, আর সামথিং ব্যাপারটা হচ্ছে আরোপিত। অর্থাৎ বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো কিছু তৈরি হতে পারেনা। 

কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞানীরা সেই ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বলেন 'নাথিং' ব্যাপারটা অস্থিতিশীল।কোয়ান্টাম জগতের নিয়মকানুন অনুযায়ী কিছু 'না থাকার' অবস্থা থেকে 'কিছু থাকার' অবস্থায় পৌঁছানো যায় সহজেই। 

তাই কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, বরং নিতান্ত প্রাকৃতিক উপায়ে শুরুতে পদার্থ প্রতি-পদার্থের মধ্যে অসমতা তৈরি হয়েছিল, এবং তার অন্যতম কারণ 'শূন্য ব্যাপারটা অস্থিতিশীল'। 

এবং এটাই বিজ্ঞানের চোখে আমাদের অস্তিত্বের মূল কারণ। এজন্যই কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে বলে আমরা জানি। 

শূন্য আর অসীম-- এর মাঝেই যেন আমাদের বাস। বিজ্ঞান আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভব হচ্ছে, আবার তা সংখ্যায় একটি দুটি নয়, অসীম সংখ্যক! শূন্য আর অসীম যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে মাল্টিভার্সের জগতে এসে।


শূন্যের মাঝে অসীম


বলা যায়--

শূন্যতার মাঝে অস্তিত্ব প্রকাশমান

শূন্যতায় হব বিলীন।



Post a Comment

0 Comments