বিজ্ঞানকে বদলে দেওয়া নারী - গের্টি কোরি


"Women Who Changed Science" শিরোনামে নোবেল কমিটির প্রকাশিত নারী বিজ্ঞানীদের  অবদান নিয়ে প্রকাশিত সিরিজে একজন  নারী বিজ্ঞানী হলেন নোবেল বিজয়ী গেটি কোরি। তার জীবনীটি অনুবাদ করেছেন তানজিলা ইসলাম ঋতু 



গের্টি কোরি কোষীয় শক্তি সংরক্ষন ও ত্যাগ সংক্রান্ত পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যেটি মানবদেহ কিভাবে কাজ করে তা জানার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন।
তিনি এবং তার স্বামী যিনি কিনা একই সঙ্গে তার আজীবনের গবেষণা সঙ্গী, কার্ল, একসাথে আনবিক রসায়নের স্বচ্ছতা তুলে ধরার এবং জীববিজ্ঞানের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এটি প্রয়োগের মাধ্যমে জীববিজ্ঞানের চর্চায় নতুন এক মোড় এনে দেন।
(ছবি: ১৯৪৭ সালে কার্ল ও গের্টি কোরির ফটোআনুবীক্ষনীক
 যন্ত্রে তোলা গ্লুকোজ-১-ফসফেট স্ফটিকের ছবি)





গের্টি কোরি ১৮৯৬ সালে, প্রাগে(Prague), গের্টি তেরেসা রাদনিত নামে একটি ধনী ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট বেলা থেকেই তার গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহের ব্যাপারে তার এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আংকেলের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে বড় হন। এবং তারই অনুপ্রেরনায় মেডিকেল কলেজে ভর্তির আবেদন করেন।
কলেজটি মেয়েদের ভর্তির ব্যাপারে সুযোগ প্রদান করলেও যেহেতু মেয়েদের স্কুলে ল্যাটিন, গণিত, পদার্থ, রসায়ন পড়ার সুযোগ থাকেনা তাই খুব কম সংখ্যক মেয়েই এন্ট্রান্স পাশ করার সুযোগ পায়।

(ছবি: ওয়াশিংটন মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীবৃন্দ, ১৯৩৯, গের্টি কোরি ডান দিক থেকে তিন নাম্বার জন। তিনি তখন সহকারী গবেষক হিসেবে কাজ করতেন)

কোরি একটা বছর পরিক্ষার জন্য খুবই কঠোর পরিশ্রম করেন এবং যেটিকে তিনি পরবর্তী জীবনে সবচেয়ে কঠিন পরিক্ষা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। অতঃপর ১৯১৪ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।


মেডিকেল কলেজে কোরি নিজের জীবনের আসক্তি খুঁজে পান: বায়োকেমিস্ট্রি ও কার্ল কোরি।
কার্ল এবং তার এনাটমি ক্লাসে দেখা হয় আর তারপর থেকে তারা পড়াশোনা, পাহাড়ে চড়া, স্কি করা কিংবা গবেষণায় একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যান।
২৪ বছর বয়সে কোরির ডিগ্রি পাবার পরপরই, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
(ছবি: গের্টি ও কার্ল, ওয়াশিংটন মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের
ল্যাবরেটরিতে কর্মরত, USA, ১৯৪৭)
কিন্ত তৎকালীন রাজনীতি তাদের এই আনন্দের মধ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
১৯২০ সালে পূর্ব ইউরোপ তখনও যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। তারই সাথে তাল দিয়ে বাড়ছিল ইহুদী বিদ্বেষ।
কার্লকে বিয়ে করবার জন্য যদিও কোরি তখন ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তবুও তার ইহুদী বংশপরিচয়ের জন্য এই নতুন দম্পতির পেশা এমনকি তাদের জীবনও হুমকির মুখে পরে যায়।
কোরি দম্পতি ১৯২২ সালে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির আশায় ইউরোপ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
কার্ল বাফালো(Buffalo),নিউ ইয়র্কে Institute for the study of Malignant Disease এর ল্যাবে কাজ নেন এবং তার স্ত্রী সেখানেই সহকারী প্যাথলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন। আমেরিকায় তারা এক বিজ্ঞানসমৃদ্ধ পরিবেশ পান।
তারা ১৯২৮ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব পান।

(ছবি: গের্টি কোরি, বেকার মেডিকেল লাইব্রেরি,
ওয়াশিংটন মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয় )

"আমি দুটি সভ্যতার অনুগ্রহ স্বীকার করি ----প্রথমত ইউরোপীয় শিক্ষার স্বাধীনতা এবং এই দেশের সুযোগ-সুবিধা--- আমি বিজ্ঞানে যতটুকু অবদান রেখেছি তার জন্য এই দুটি খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।"
- গের্টি কোরি

যদিও কোরি দম্পতি ল্যাবে একই রকম কাজ করতেন, তবুও তাদের সমান মর্যাদা দেয়া হত না।
বাফোলোতে আট বছরে তারা একসাথে ৫০ টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং তাদের গবেষণার জন্য উপযুক্ত আরও ভাল কোনো জায়গায় খোঁজ করেন। কিন্ত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই গের্টিকে তার উপযুক্ত সম্মান ও মজুরি দিয়ে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে রাজি ছিলনা।

বাফালোতে কার্ল কোরি একটি প্যাথোলজি ল্যাবে কাজ করতেন এবং গের্টি কোরি সেখানে প্যাথোলজি এসিস্ট্যন্ট হিসেবে ছিলেন।
কার্ল যখন ১৯৩১ সালে ওয়াশিংটন মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন, গের্টি সেখানে কেবলমাত্র একজন গবেষণা সহকারী।
১৬ বছর পর(নোবেল পুরস্কার পাবার ২ মাস পর), অবশেষে গের্টি প্রফেসর পদে উন্নীত হন।
( ছবি: গের্টি এবং কার্ল কোরি ১৯৪৭ সালে, লুইই(louis) এ-অবস্থিত
 Wasshington University school of Medicine এ-তাদের ল্যাবে কাজ করছেন)


কোরি দম্পতির গবেষণার বিষয় ছিল শর্করা বিপাক প্রক্রিয়া, তারা মানবদেহে এই প্রক্রিয়াটি উন্মোচন করেন। ১৯২৯ সালে তারা এটিকে কোরি চক্র নামে অভিহিত করেন এবং কিভাবে মানবদেহে, শর্করা পেশীতে গ্লাইকোজেন রূপে জমা থাকে, তারপর এটি যকৃতে ব্যবহারযোগ্য রূপে রূপান্তরের জন্য যায় এবং অতঃপর গ্লুকোজ রূপে আবার পেশীতে ফিরে আসে এটির বিশদ বর্ণনা প্রদান করেন।

যদিও কোরি চক্র তাদের নাম সবার সামনে নিয়ে এসেছিল, কিন্ত তাদের পরবর্তী সাফল্য তাদের জীবনে এক বিরাট প্রভাব ফেলে। সেটি ছিল ১৯৩১ সালে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া।
সেখানে তারা গ্লাইকোজেন এর ভাঙ্গন সম্পর্কিত পড়া শুরু করেন এবং কয়েক বছরের পরিক্ষা শেষে তারা গ্লাইকোজেনের ভাঙনের জন্য দায়ী এনজাইমের সন্ধান পান। এবং তারা এনজাইমটি উল্টোভাবে গ্লাইকোজেন তৈরির কাজেও ব্যবহার করেন। এই পরিক্ষাটি ছিল সজীব কোষের বাইরে সংরক্ষিত পরিবেশে এধরনের জৈবরাসায়নিক গবেষণার অগ্রদূত।

(ছবি: কার্ল ডাউটেন(ডানে), সভাপতি, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় পুরুষ অনুষদ, বাকি তিনজন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নোবেল বিজয়ী : যোশেফ এরল্যাংগার(Joseph Erlanger)(বামে), ১৯৪৪ সালে শরীরবিদ্যা বা চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী, এবং কার্ল ও গের্টি কোরি, ১৯৪৭ সালে শরীরবিদ্যা বা চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী।)




(ছবি:২: নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে গের্টি ও
কার্ল কোরি, স্টকহোম,১০ ডিসেম্বর,১৯৪৭)

গের্টি কোরি এবং তার স্বামী, কার্ল ১৯৪৭ সালে শরীরবিদ্যা বা চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছেন। এবং গের্টি নারী হিসেবে প্রথম এই সম্মানের অধিকারি ছিলেন।


" আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় ছিল বহুবছরের পরিশ্রমের পর, যখন প্রকৃতির রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হল এবং এই রহস্যের ধোঁয়াশা যখন এক সুন্দর আলোয় স্বচ্ছ হয়ে উঠল। "
   ---গের্টি কোরি
এই পুরস্কার পাবার পর অবশেষে কোরি প্রফেসর পদে উন্নীত হন এবং বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় গভীরভাবে ডুব দেন। তিনি নতুন নতুন এনজাইম, তাদের সর্বব্যাপী কাজ, বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবে এনজাইমের অপ্রতুলতা খুঁজে বের করার কাজ করতে থাকেন।
তার জীবনের শেষ বছর ছিল কর্মময় কিন্ত কঠিন যেহেতু তিনি মিয়েলোফাইব্রোসিস, এক ধরনের বোন ম্যারো রোগের কাছে হার মেনেছিলেন ফলশ্রুতিতে তাঁর সার্জারি অপারেশন, রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় এবং শেষ পরিণতিতে কেবল এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষ পর্যন্তই যেতে পারতেন।
কোরি ১৯৫৭ সালে, ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
বিজ্ঞানে তার অবদানের জন্য আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
(ছবি: গের্টি কোরি, ১২ জন বিশিষ্ট নারীদের মধ্যে একজন যারা
স্মিথ কলেজ(Smith College) এর ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে
(ছবি: হারমেন কালকার( Herman Kalcker) এর কাছে গের্টি কোরির চিঠি, ১২ জুলাই, ১৯৫৭ )

(ছবি: হারমেন কালকার( Herman Kalcker) এর কাছে গের্টি কোরির চিঠি, ১২ জুলাই, ১৯৫৭ )


মূল আর্টিকেলটির লিংকঃ
https://www.nobelprize.org/womenwhochangedscience/stories/gerty-cori?fbclid=IwAR2PKExeZM3OGOMl0RcrSzHmVCDV71VIz1x0PIHouFe3nTOCkKbvotQVma0

Post a Comment

0 Comments