লকডাউনের কালে সৃজনশীলতা

লেখাটি লিখেছেন Dan Falk. তিনি একজন
বিজ্ঞান সাংবাদিক। লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন শাইরা তাসনিম অর্পা। 


সম্প্রতি সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ওয়াশিংটন পোস্ট) অনুসারে স্পষ্টত আপনারা দেখছেন যে, আইজ্যাক নিউটনের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল এক প্লেগ মহামারীর প্রাদুর্ভাবকালে।

প্লেগের সময়ে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেলে নিউটন তার পরিবারের কাছে ল্যাংকাশায়ারে ফিরে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি উল্লেখযোগ্য সৃজনশীলতার বিস্ফোরন ঘটেয়েছিলেন। সেখানে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন অভিকর্ষ ও আলোকবিদ্যা সম্পর্কিত মতবাদের মূলতত্ত্বগুলো এবং আবিষ্কার করেন ক্যালকুলাস।



শেক্সপীয়ারের ম্যানুস্ক্রিপ্ট 
Credit: Getty Images

শুধুমাত্র নিউটন নন, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও লিখেছিলেন তার সেরা কিছু কবিতা ও নাটক যখন আরেকটা  প্লেগের কারণে লন্ডনের নাট্যশালা বন্ধ করতে হয়েছিল। হয়তো আমাদের মাঝেও কেউ কেউ নিউটন বা শেক্সপিয়ারের  সমপর্যায় পৌঁছাতে পারবে। তাই সম্প্রতি 'সাইকোলজি টুডে' তে বলা হচ্ছে  মহামারীর কারনে এই বন্দী দশার সময়টুকুর অপব্যবহার করা উচিত না। করোনাভাইরাস জনিত এই বন্দী দশা শিক্ষার্থীদের জন্যে তাদের ভবিষ্যত উদ্দ্যেশ্যের পরিপূরক প্রস্তুতির নেওয়ার সময় ।

চলুন গভীরভাবে দেখি 'প্লেগ' কিভাবে এই দুজন পোস্টার বালকের থেকে মহামূল্যবান আবিষ্কার করিয়ে নিয়েছিলো। নিউটনকে দিয়েই শুরু করা যাক।
রিচার্ড ওয়েস্টৈল তার 'নেভার এট রেস্ট ' জীবনীটিতে লিখেছিলেন,মহামারীটি ১৬৬৫ এর গ্রীষ্মে ক্যামব্রিজকে আঘাত করেছিল। তখন নিইটন সবেমাত্র  স্নাতক পাশ করে ফিরে আসেন ৫০ মাইল এর বেশি উত্তরে 'ওলস্টোর্প ম্যানোর'। তিনি সেখানে দেড় বছরের মতো অবস্থান করেছিলেন। এবং দৃশ্যত এই সময়ই তাঁর সৃজনশীলতা বিকশিত হয়েছিলো। তাই সেই সময়টি প্রায়শই তাঁর 'অ্যানুস মিরাবিলিস' (উল্লেখযোগ্য বর্ষ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নিউটন তাঁর গোড়ার দিকের একটি জীবনীতে বলেছিলেন,"সেই সময় আমি আমার আবিষ্কার বা উদ্ভাবনের জন্য আমার বয়সের শীর্ষস্থানে ছিলাম।" সম্ভবত সেই সময়ে নিউটনের শ্রেষ্ঠ আবিস্কার ছিল মহাকর্ষের ইনভার্স-স্কয়ার সূত্রের উন্নতি যার মাধ্যমে একই সাথে আপেল পতনের ঘটনা ও পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চাঁদের ঘূর্ণনের  ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছিল। 'নিউটনের উপর আপেল পড়া থেকে নিউটন মহাকর্ষ সূত্র আবিস্কার করেছিলেন' অন্যান্য মিথের মতই এটিরও কিছুটা সত্যতা ছিল। নিউটনের বাড়ির কাছে এক জমিদার বাড়ির পাশে  ছিল এক আপেল গাছ। (এদের বংশধরদের একজন এখনো জীবিত আছে)।

ওয়েস্টফলের লেখনী মতে, নিউটন গল্পটির কিছু সংস্করন বিভিন্ন ব্যাক্তিকে বলেছিলেন।(যদিও তিনি গল্পগুলো বলেছিলেন শেষ জীবনে)
প্লেগের সময়টা ছিল নিউটনের প্রতিভার বিকাশের সূচনা বিন্দু। তিনি সবেমাত্র মহাকর্ষীয়  আকর্ষন সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছিলেন এর সার্বজনীনতা আলোকে।
পাশাপাশি নিউটন তার এই বিচ্ছিন্নতার সময়কালে গনিত এবং পদার্থবিজ্ঞানেরর দিকে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন এবং তিনি তাঁর সাধনা চালিয়ে যেতে থাকেন ফলশ্রুতিতে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ প্লেগের পরও অব্যাহত থাকে। 

আপরদিকে শেক্সপিয়ার কি করেছিলেন?
রানী এলিজাবেথ -১ এবং তার উত্তরাধীকারী জেমস -১ এর সময়কালেও প্লেগ/ মহামারীটি বহমান ছিলো। সেখানে যখন মৃতের সংখ্যা প্রতি
সপ্তাহে ৩০ ছাড়িয়ে গেল লন্ডনের সকল নাট্যশালা বন্ধের নির্দেশ আসলো।১৬০৬ সালে মহামারীটি বিপজ্জনক রূপ লাভ করলো।শেক্সপেয়ার তখনও তাঁর সময়ের যথাযথ ব্যবহার করলেন। লিখলেন 'কিং লেয়ার', 'মেকবেথ', 'এন্টনি ও কিউপেট্রা' নাটকগুলো । এখনকার মতো তখনও লন্ডনে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার কথা বলা হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে জেমস শেপিরো ১৬০৬ সালে লিখেছিলেন : শেক্সপিয়ার এবং ইয়ার অফ লিয়ার। তখন ধর্মজাজক এবং কফিন বহনকারী সহ ছয়জনের বেশি কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতেন না।(যদিও অন্যান্য নিয়ম প্রায়শই উপেক্ষিত হতো)

মহামারীতে যারা অসুস্থ হতো তারা রাস্তায় চলাচলের সময় লাঠি জাতীয় জিনিস ব্যবহার করতেন যাতে অন্যরা বুঝতে পারেন যে তারা রোগাক্রান্ত এবং সেসময় তারা আক্রান্ত দের থেকে দূরে থাকতে পারত। এরপূর্বে ১৫৯৩ সালে যখন আরো একবার নাট্যশালা বন্ধ করা হয়েছিলো তখন শেক্সপিয়ার 'ভেনাস এন্ড এডোনিস' কবিতাটি লিখেছিলেন।
ঐ মাসের মাঝামাঝিতে তাঁর রচিত একটি লেখা  সংগীতকার Rosamne Cash এর দৃষ্টি আকর্ষন করে। কিন্তু শিঘ্রই তার এক বার্তায় তিনি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানান। একদিন পরের প্রতিক্রিয়া ছিলো এমন যে, " বিষয়টি চমৎকার। কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি সেসময় সে শিশুদের দেখবাল করছিলেন।"
(প্রকৃতপক্ষে শেক্সপেয়ার এর স্ত্রী এবং সন্তানরা ছিলো তার থেকে ৮০ মাইল দূরে স্ট্রাটফোর্ড এভোনে।

অন্য একজন বলেছিলেন,"কিং লেয়ারের সবকিছুই ভালো কিন্তু  'মেরিকো কার্ট' নামে অন্য আরেকটা নাটক মঞ্চস্থ করবেন। আরেকটা বার্তায়  প্রকাশিত হয় শেক্সপিয়ার তাঁর প্রায় ব সব কিছুই  প্লেগের সময় লিখেছিলেন এমনকি তিতাস এন্ড্রোনিকাসের বিরক্তিকর অংশটুকু সহ।

এখন অনেকেই জানে বাড়িতে অবস্থান করে কাজ কোন 'সুযোগ ' না। এটা কেবল তাদের জন্যই সুযোগ যাদের বাড়িতে ডিস্টার্ব করার জন্য কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই। ব্যতিক্রম শেক্সপেয়ার। নিউটন ছিলেন নিঃসন্তান (সম্ভবত চিরকুমার)
অবশ্যই নিউটন বাড়ি থাকাকালীন সময়ে তার মা-বাবার সহযোগিতা পেয়েছিলেন যদিও তারা ধনী ছিলেন না। 

একজন টুইটার ব্যবহারকারী এ প্রসঙ্গে টুইট করেছিলেন যে তার বাচ্চার মতো কেউ নিউটনের থাকলে নিউটনের এই প্রতিভা বিকাশ সম্ভব ছিল না।  অন্য আরেকজন টুইট করেছেন "নিশ্চয়ই আইজ্যাক নিউটনের বাড়িতে নেটফ্লিক্স বা নেনটিডো এর মতো কোনো সুবিধা ছিলো না।"

গৃহবন্দি অবস্থায় কারো  এই উচ্চপ্রতিভার অধিকারী হওয়ার বিষম আশা তাকে পিছিয়ে দিতে পারে।"নিউ পাবলিক" এ নিউ মার্টিন এর লেখা যার প্রকৃত সত্যটি তুলে ধরেছেন এভাবে যে: জীবনের প্রতিটি ঘন্টাকে উৎপাদনশীল করতে চাওয়ার প্রবণতা আমেরিকার জন্যে কাল হয়ে দাড়াবে। সব কিছুকে পন্যে রূপান্তরিত করা এবং পুজিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আমেরিকার জন্য  স্বাভাবিক ভাবেই ভালো ফল নিয়ে আসবে না।

অবশ্য, ইতোমধ্যেই যারা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতেই হিমশিম খাচ্ছে তাদের কাছে থেকে এই রকম উদ্ভট উচ্চাশা করা অবাস্তবই বটে।   
এবং দ্বিতীয়ত, নিউটন বা শেক্সপিয়রের মতো প্রতিভাশালী না হলেও আমাদের লজ্জা থাকা উচিত নয়।

তাই, নিজের এবং  আশে-পাশে যারা  রয়েছেন তাদের যত্ন নিন। আপনাকে  নতুন কোনো ভাষা শিখতেই হবে বা বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী হতেই হবে , বা একটি চিত্রনাট্য লিখতেই হবে বা 'থিয়োরি অব এভ্রিথিং' ব্যাখ্যা করতে পারতেই হবে এমন নয়।  আপনার সামনে যা আছে তা নিয়েই যথাযথ কাজ করা  যথেষ্ট।

মূল আর্টিকেলের লিংকঃ  https://blogs.scientificamerican.com/observations/must-we-all-become-more-creative-because-of-the-pandemic/

Post a Comment

0 Comments