কোভিড ১৯ এ মৃত্যু ঘটে কেন?

কোভিড ১৯ এর আক্রমণে রোগীর মারা যাওয়া বা অসুসস্থ হওয়ার সুনির্দিষ্ট মেকানিজম আবিস্কৃত না হওয়ায় ডাক্তাররা এখনো  সঠিক ট্রিটমেন্ট কোনটা হবে সেটা নিয়ে সন্ধিহান। এমন কি এমন ঔষুধ দেওয়া হচ্ছে তাতে করোনার বিরুদ্ধে রোগীর নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। নিম্নোক্ত আর্টিকেলটি নেচার জার্নালে গত ৯ এপ্রিল প্রকাশিত হয়।

লিখেছেন  Heidi Ledford 

অনুবাদ  করেছেন মাহমুদুল হাসান রাজু


কোভিড-১৯ এ গুরুতর অসুস্থ হওয়া বা মৃত্যু ঘটার জন্য কোনটি দায়ী? ভাইরাস নাকি ভাইরাস কর্তৃক সৃষ্ট প্রতিরক্ষা-সাড়া(Immune Response) যেটা চূড়ান্তভাবে রোগীর অঙ্গ (যেমন:ফুসফুস) আচ্ছন্ন করে ফেলে, এই ব্যাপারটায় ডাক্তাররা এখনো নিশ্চিত হতে না পারায় করোনায় মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
কোভিড ১৯ আক্রান্ত রোগীর ফুসফুস
 
Credit: Sergei Krasnoukhov/TASS/Getty


এক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ডাটা বলছে এ রোগে রোগীদের অবস্থার অবনতি বা মৃত্যুর জন্য প্রতিরক্ষা-তন্ত্র(Immune System) একটা ভূমিকা পালন করে যা ডাক্তারদের স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ প্রয়োগের দিকে ঝুঁকাচ্ছে যেটা মূলত প্রতিরক্ষা-সাড়া কমিয়ে দেয়। কিন্তু এই ধরনের চিকিৎসা পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেই দূর্বল করে দেয় যা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে শরীর নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাকৃতিক সামর্থ্যটা ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশংকা তৈরি করে।

"আমার সবচেয়ে বড় ভয় এই যে, এটা এমন চরমে পৌছাচ্ছে যে মানুষ প্রতিরক্ষা-সাড়া বন্ধ করার জন্য হাতের কাছে যা পাচ্ছে ব্যবহার করছে"-জানালেন মাউন্টেন ভিউ,ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত আইজিএম বায়োসায়েন্স এর ইমিউনোলজিস্ট এবং চিফ মেডিক্যাল অফিসার ড্যানিয়েল চেন।উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বলেন "ইমিউন সিস্টেমে এভাবে আঘাত হানা উচিৎ নয় বিশেষত যখন এটি একটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ছে"।

চিকিৎসার জন্য তাড়াহুড়ো 

বিশ্বব্যাপী হাসপাতালগুলোতে রোগী উপচে পড়ায় ফিজিশিয়ানরা অজস্র অসম্পূর্ণ ডাটা এবং প্রি-প্রিন্ট এর নির্ভর করছেন যেগুলো পিয়ার-রিভিউড না। কারণ এই সংকটের মুহুর্তে রোগীদের প্রাণ বাঁচানোই মূখ্য ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ এর ইনটেন্সিভ কেয়ার এনেস্থেসিস্ট কেনেথ বেইলি বলেন "ডাক্তাররা চোখের সামনে রোগীদের অবস্থার অবনতি হতে দেখছেন। যার কারণে  কার্যকরী মনে হয় এমন যেকোনো থেরাপির দ্বারস্থ হতে প্রেষণা পাচ্ছেন তারা" । তিনি আরও বলেন " আমিও এমনটাই অনুভব করি যখন রোগীর বেডের পাশে নিজেকে অসহায় মনে করি" ।

শুরুর দিকে চায়নার করোনা আক্রান্ত রোগীদের রিপোর্ট বিশ্লেষণ বলছে সম্ভবত ফুসফুস এর কার্যকারিতা ধ্বংস এবং সবশেষে মৃত্যু  ঘটানো এই ব্যাপারটা কেবল ভাইরাস এর দ্বারা সংঘটিত হচ্ছেনা বরং  প্রতিরক্ষা-সাড়ার অতিসক্রিয়তাই হয়ত এর জন্য দায়ী। যেসব রোগীরা কোভিড-১৯ এ সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিলেন তাদের রক্তে উচ্চমাত্রায় সাইটোকাইন নামক প্রোটিন এর উপস্থিতি ছিলো যেটি প্রতিরক্ষা-সাড়া দ্রুত সক্রিয়  করে। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাড়া দানকারী(Signalling protein) সাইটোকাইন এর কথা উল্লেখ্য। সেটি হচ্ছে ইন্টারলিউকিন-6 (interleukin-6)। এটি প্রতিরক্ষা-তন্ত্রের উপাদানগুলোকে (যেমনঃ ম্যাক্রোফেজ; ম্যাক্রোফেজ প্রদাহ ত্বরান্বিত করে এবং সুস্থ ফুসফুস কোষগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলতে পারে) জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ডাক দেয়। এইসব সাইটোকাইন এর নিঃসরণকে বলা হয় সাইটোকাইন ঝড়(Cytokine Storm) যেটা অপরাপর ভাইরাসের সংক্রমণে ও ঘটে যেমনঃ এইচআইভি।

তাহলে সঠিক প্রতিকার হবে এমন কোনো ঔষধ যেটা ইন্টারলিউকিন-৬(আইএল-৬) এর ক্রিয়া হ্রাস করে এবং ফুসফুসে ম্যাক্রোফেজের প্রবাহ কমিয়ে দেয়। এ ধরনের ঔষধ যেগুলোকে আইএল-৬ ইনহিবিটর বলা হয় ইতোমধ্যে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে রোচ(Roche) নামক একটি সুইজারল্যান্ডের ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্মে তৈরি একটি আইএল-৬-ইনহিবিটর একটেমরা(Actemra) করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য চায়নাতে অনুমোদন পেয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় গবেষকরা এই ওষুধটির কার্যকারিতা এবং এ ধরনের আইএল-৬ ইনহিবিটর নিয়ে কাজ করছেন।

ইমিউন চ্যালেঞ্জ

সারা বিশ্বে এ নিয়ে যথেষ্ট ঔষধ নেই এবং ক্লিনিশিয়ানরা স্টেরয়েড প্রয়োগের দিকে ঝুঁকছেন যেটা পুরো প্রতিরক্ষা-তন্ত্রকেই অকার্যকর করে-বলেন মেরিল্যান্ড এ অবস্থিত ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট এর ইমিউনো-অনকোলজিস্ট জেমস গালি। অন্যদিকে আইএল-৬-ইনহিবিটর অন্যান্য প্রতিরক্ষা-সাড়া ব্যাহত না করে কেবল আইএল-৬ এর নিঃসরণ কমিয়ে দেয় যাতে প্রতিরক্ষা-তন্ত্র কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু স্টেরয়েড বা অন্যান্য ঔষধগুলো সাধারণভাবে যেকোনো সংক্রমণের ক্ষেত্রেই শরীরের প্রতিরক্ষার সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই ঔষধগুলো কেবল ম্যাক্রোফেজের নিঃসরণই নিয়ন্ত্রণ করেনা বরং CD4 T নামক এক ধরণের প্রতিরক্ষা-কোষ(Immune cell) এর প্রবাহও দমন করে যেটি প্রতিরক্ষা-সাড়ার সূচনা করে। পাশাপাশি CD8 T কোষের প্রবাহও ক্ষতিগ্রস্ত করে যেটি শরীরের প্রবেশিত ভাইরাস এর গুপ্তঘাতক হিসেবে পরিচিত এবং ম্যাক্রোফেজের তুলনায় অধিক নিখুঁতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ ধ্বংস করে। জেমস গালি বলেন "পরিস্থিতি খারাপ হলে লোকজন স্টেরয়েড এর দিকে ঝুঁকবে। এবং আমি এটা নিয়ে চিন্তিত" ।

চেন উল্লেখ করেন যদিও গুরুতর অসুস্থ রোগীদের দেহে আইএল-৬ এর মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে যেখানে ভাইরাল লোডও উচ্চমাত্রায় বিদ্যমান যেটি প্রমাণ করে রোগীর দেহ একটি সক্রিয় ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ছে। তিনি বলেন "আপনাকে বুঝতে হবে যে এই রোগীদের শরীরে ভাইরাস এর বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষা-সাড়া চলমান যেটি তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ" । যদি ব্যাপারটা এরকম হয় সেক্ষেত্রে CD4 এবং CD8 T কোষ এর নিঃসরণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানে পুরো প্রতিরক্ষা-সাড়াটিই দূর্বলতর হয়ে পড়া।

স্টেরয়েড এবং অন্যান্য সাড়া অবদমনকারী(immune response reducing) ড্রাগ ইতোমধ্যেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর অধীনে পরীক্ষা করা হচ্ছে করোনাভাইরাস এর চিকিৎসায়। গত মার্চে যুক্তরাজ্যের গবেষকরা একটা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর সূচনা করেছেন কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় স্টেরয়েড ডেক্সোমেথাসোন এবং অন্যান্য সম্ভাব্য ড্রাগের কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য। এই ব্যাপারটা লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হসপিটাল এর জেসিকা ম্যানসন কে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত করছে। সমগোত্রীয় করোনাভাইরাস দ্বারা সংঘটিত বিগত মহামারীগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এই ক্ষেত্রে স্টেরয়েড খুব কমই ভূমিকা রাখতে পারে বরং কিছু ক্ষেত্রে এটি সেরে ওঠার সময় ও প্রলম্বিত করতে পারে বলে তিনি জানান। এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কেবল রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার পূর্বে ব্যাবহারযোগ্য ড্রাগের জন্য যখন অন্য কোনো উপায় থাকবেনা বাঁচানোর।

কিন্তু এই ট্রায়াল্ এর নেতৃত্বে থাকা পিটার হরবি যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংক্রামক রোগ নিয়ে পড়ছেন জানান যে এই ট্রায়ালে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার স্টেরয়েড নিয়ে পরীক্ষা চালানো হবে। "সাধারণত উচ্চমাত্রায় কাজ করতে বলা হয়না এবং এক্ষেত্রে জুরিরা নিম্নমাত্রার স্টেরয়েড নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন" "এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ট্রায়ালের প্রস্তাব দিয়েছেন"- তিনি আরও যোগ করেন ।

কম্বিনেশন থেরাপি

একইসাথে ভাইরাস এবং শরীরের প্রতিরক্ষা-তন্ত্র কর্তৃক মিলিতভাবে ক্ষতিসাধন নতুন কিছু নয়-বললেন জর্জিয়ার ইমোরি ইউনিভার্সিটির ভাইরাল ইমিউনোলজিস্ট রাফি আহমেদ।তিনি বলেন- নোরোভাইরাস এর মত 'হিট এন্ড রান' ভাইরাস এর আক্রমণে মানুষ দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার প্রায় সাথে সাথেই,যেটা খুব সম্ভবত কেবল ভাইরাস এর প্রতিক্রিয়ায়। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের মত ভাইরাস এর সংক্রমণে শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করার কিছুদিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয় অর্থ্যাত এক্ষেত্রে সুপ্তাবস্থা থাকে। অতঃপর ইমিউন সাড়াও ভাইরাস এর পাশাপাশি ক্ষতিসাধনে ভূমিকা রাখে । আহমেদ বলেন, "এর মধ্যে কতটুকু ক্ষতি ভাইরাস দ্বারা আর কতটুকু প্রতিরক্ষা-সাড়া দ্বারা সেটা নির্ণয় করা কঠিন।তবে এটা সবসময়ই দুটোর সম্মিলিত ফলাফল" ।

এই প্রশ্নের সমাধান না পেলেও আহমেদ আশাবাদী যে গবেষকরা 'আইএল-৬-ইনহিবিটর + এন্টিভাইরাল ড্রাগ' এর মত একটা 'কম্বিনেশন থেরাপি' তে উপনীত হবেন  যেটা প্রতিরক্ষা-তন্ত্রের কাজে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে শুধুমাত্র ভাইরাসটিকেই টার্গেট করবে । অন্যান্য ড্রাগ যেগুলো প্রতিরক্ষা-সাড়াকে টার্গেট করবে সেগুলোও টেস্ট করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ড্রাগ হচ্ছে এনাকিনরা(Anakinra) যেটা আইএল-১ কে টার্গেট করে এবং CD4 ও CD8 T কোষের ক্ষতি না করে কেবল বিশেষ প্রতিরক্ষা-সাড়াকে কমাতে পারে।

কিন্তু বেইলি বলেন যে স্টেরয়েড এর সর্বব্যাপী ব্যাবহার এর পাশাপাশি এক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ করাও জরুরি।যদিও তিনি স্টেরয়েড দিয়ে রোগীদের প্রতিরক্ষা-সাড়া দমন করা নিয়ে উদ্বিগ্ন তথাপি আশা করেন এই ব্যাবহারও কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে । "একমাত্র দায়িত্বশীল কাজ হচ্ছে এই ব্যাবহারটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর আওতায় করা " তিনি যোগ করেন "এছাড়া আর কোনো উপায় নেই বুঝার কোনো চিকিৎসা আসলেই কাজ করছে কিনা "

মূল আর্টিকেলের লিংকঃ  https://www.nature.com/articles/d41586-020-01056-7

Post a Comment

0 Comments